সিলেট প্রেসক্লাব আয়োজিত নাগরিক সংলাপ
সংস্কারের কিছু বিষয়ে সবার ঐকমত্য প্রয়োজন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৩:২২ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বলেছেন, সংস্কার বিষয়ে সবাই সব জায়গায় একমত নাও হতে পারেন। তবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে সবার মধ্যে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য প্রয়োজন। তিনি বলেন, দেশপ্রেমকে প্রথমে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে। কারণ আমাদের অনেকের মধ্যে দেশ প্রেমের চেয়ে নিজের প্রেম, গোষ্ঠী প্রেম অনেক বেশি।
গতকাল শনিবার সিলেটের শত বছরের সাংবাদিকতার স্মারক প্রতিষ্ঠান সিলেট প্রেসক্লাবের উদ্যোগে নগরীর রিকাবিবাজারস্থ কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে সংস্কার, জাতীয় ঐক্য ও ভাবনা বিষয়ক এক নাগরিক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি ইকরামুল কবিরের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের সঞ্চালনায় এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. কামাল আহমদ চৌধুরী।
সংলাপে মতামত ব্যক্ত করেন- সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, মহানগর জামায়াতের আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন, লিডিং ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. বশির আহমদ ভূইয়া, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফয়েজ হাসান ফেরদৌস, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি সিলেটের উপ-পরিচালক শাহ মো. নজরুল ইসলাম, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফয়েজ আহমদ, সিলেট প্রেসবিটারিয়ান চার্চের সভাপতি ডিকন নিঝুম সাংমা, ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হাসান, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক জোটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ফরিদ আহমদ, উইমেন ফর উইমেন রাইটসের সভাপতি সামিয়া বেগম চৌধুরী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দেলোয়ার হোসেন শিশির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ মোস্তাক আহমদের ভাই সোহেল আহমদ প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক এ কে এনামুল হক আরো বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে ২০১০-২০২৩ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র উন্নয়ন বাজেটে ৭ হাজার লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১০ থেকে ২০২৩-২৪ সেশনে উন্নয়ন বাজেটে খরচ হয়েছে ১৭ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এই টাকা কোথাও না কোথাও তো গেছে। এই টাকা শুধু রাজনীতিবিদের কাছেই যায়নি ; সরকারি আমলাদের ভাগ আরো বেশী। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, আগে মানুষ টেবিলের নিচ দিয়ে ঘুষ নিতো। কিন্তু, গত ১৫ বছরে ঘুষের জন্য টেবিল সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছি দেশকে পিছনে ফেলে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা বেশিদিন হয়নি, মাত্র ৬ মাস হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ১৫০ টিরও বেশি আন্দোলন হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছেন সবাই সবারটা নিয়ে ব্যস্ত, সবাই ভাবছে এই হচ্ছে একমাত্র সুযোগ। এই যে চিন্তা ভাবনা এটা থেকেই এতসব আন্দোলন। এই আন্দোলন কমছে না, বরং বাড়ছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমাদের প্রথম চিন্তা হওয়া উচিত দেশাত্মবোধ, ন্যায়বোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সমাজের জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে। আইন পরিবর্তন করতে হয় মানুষের আচরণে। মানুষের আচরণ বদলায়, আইনও পরিবর্তন করা দরকার।
সংলাপের মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. কামাল আহমদ চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের রাজনৈতিক ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। পরবর্তীতে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গঠিত হয়েছে সংস্কার কমিশন।
এ প্রসঙ্গে তিনি প্রখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের কথা তুলে ধরে বলেন, আড়াই হাজার বছর আগে তরুণদের কাছে সত্য কথা না বলতে পারার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এদেশের ছাত্র জনতাও মৃত্যুকে বরণ করে ফ্যাসিবাদকে বিতাড়ন করেছেন। এখন এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালিত করতে অনেকগুলো সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
ড. কামাল আহমদ চৌধুরী বলেন, আমাদের সংবিধান থাকলেও কখনও সংবিধান অনুযায়ী দেশ শাসিত হয়নি। ১৯৫৬ সালের আগে সংবিধান ছিল না। হোসেন সোহরাওয়ার্দী সংবিধান দিলে আইয়ূব খান সেই সংবিধান স্থগিত করেন। ১৯৭২ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হলে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৩ সালে সংবিধানের মূলে আঘাত হানা হয়। ২০০৯ সালে নতুন করে সংবিধান পরিশোধিত করা হলে সেখান থেকে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়।
নাগরিক সংলাপে দেয়া বক্তব্যে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা সফলতা লাভ করে। সকলের প্রচেষ্টায় ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এই সরকারের ওপর মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই সরকার সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে-যা হবে দীর্ঘ কাংখিত। পতিত স্বৈরাচারের অনেক দোসর অন্তর্বর্তী সরকারে থেকে সরকারের ক্ষতি করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংলাপে মহানগর জামায়াতের আমীর ফখরুল ইসলাম বলেন, বিগত সংসদে দেখেছি যারা দেখেও রিডিং পড়তে পারে না এবং যারা বাজারে বাজারে গিয়ে গান বাজনা করেছে তারাও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এগুলোর জন্যও সংস্কার ও আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। আইনের সুশাসনের জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন, সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল একজন জাতির পিতা। তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথাও সংবিধানে উল্লেখ করা হয়। এসবের জন্যই সংস্কারের প্রয়োজন।
লিডিং ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. বশির আহমদ ভূইয়া বলেন, বিডিআর হত্যা, হেফাজত হত্যা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। দেশে সুবিধাভোগীরা সব সময় ভাল অবস্থানেই থাকছে। এসব হত্যাকান্ডের বিচার না হলে দেশের অবস্থা আরো খারাপ হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে আহতরা ৬ মাস পরও সুচিকিৎসা পাচ্ছে না-এটা খুবই দু:খজনক।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফয়েজ হাসান ফেরদৌস বলেন, দেশের উন্নয়নে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সকল বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তরের দাবি জানান তিনি।
অন্য বক্তারা বলেন, প্রথমত প্রয়োজন ছিল শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। এখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে আর পড়ালেখা হয় না। এটা নিয়ে ভাবা দরকার। কেননা এই প্রাইমারি থেকেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। আগে এগুলোর সংস্কার করতে হবে এবং এগুলোর জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।
বক্তারা বলেন, সংস্কারের জন্য সবকিছু আটকে থাকতে পারে না। সংস্কার চলবে, সাথে অন্যান্য বিষয়ও চলুক। এছাড়া প্রথম সংস্কারটা দরকার ব্যক্তি মানুষের। মানুষের মধ্যে যদি নৈতিকতা না আসে, তাহলে সবকিছু পূর্বের ন্যায় থেকে যাবে। আইন কখনোই নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন বক্তারা ।
সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি ও দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহযোগিতায় আয়োজিত সংলাপের শুরুতেই ছাত্র-জনতার অভুত্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত সিলেট প্রেসক্লাবের সদস্য শহীদ এটিএম তুরাবের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়।
সংলাপে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ও নূরজাহান মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ নিজাম উদ্দিন তরফদার, জাতীয় ইমাম সমিতির সিলেট মহানগর সভাপতি মাওলানা হাবিব আহমদ শিহাব, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আবু সাদ জওহর আহমদ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী শাহ কামাল আহমদ, শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের সিলেট মহানগর সেক্রেটারি পারভেজ আহমদ, নুরজাহান কলেজের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল আজিজ, রফিকুল মোরসালিন বাবর, এম এ জলিল ও হুমায়ুন কবির জুয়েল, লামাকাজী রাগীব রাবেয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ ছিফত আলী, লাউয়াই আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা রওনক আহমদ, ব্লাস্টের সত্যজিত দাস প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রেসক্লাব সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বদর, মুহাম্মদ আমজাদ হোসাইন, আতাউর রহমান আতা, হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী ও এম এ হান্নান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সমরেন্দ্র বিশ^াস সমর, সিনিয়র সদস্য আব্দুল মালিক জাকা, ক্লাবের সহ-সাধারণ সম্পাদক শুয়াইবুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ আনিস রহমান, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ আব্দুল মজিদ, পাঠাগার ও প্রকাশনা সম্পাদক কবির আহমদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক কোষাধ্যক্ষ কবীর আহমদ সোহেল, সাবেক দপ্তর সম্পাদক কামকামুর রাজ্জাক রুনু, সাবেক সহ-সম্পাদক আহমাদ সেলিম, সাবেক ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক সম্পাদক জিয়াউস-শামস-শাহীন ও নূর আহমদ, সাবেক পাঠাগার ও প্রকাশনা সম্পাদক খালেদ আহমদ, সদস্য চৌধুরী দেলওয়ার হোসেন জিলন, মো. মুহিবুর রহমান, মো. ফয়ছল আলম, মো. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী এহিয়া, আশকার ইবনে আমিন লস্কর রাব্বী, নাজমুল কবীর পাভেল, সজল ছত্রী, দিগেন সিংহ, সিন্টু রঞ্জন চন্দ, নৌসাদ আহমেদ চৌধুরী, মানাউবী সিংহ শুভ, আব্দুল আউয়াল চৌধুরী শিপার, শফিক আহমদ শফি, সাকিব আহমদ মিঠু, সহযোগী সদস্য হুমায়ুন কবির লিটন ও এইচ এম শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।