স্বর্ণ চোরাকারবারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
ওসমানী বিমানবন্দরে এক দশকে ১৮৩ কোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৫:৪০:৩৮ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণের চোরাচালান থামছে না। একের পর এক স্বর্ণের চোরাচালান ধরা পড়লেও স্বর্ণ চোরাকারবারিরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গেল এক দশকে কেবল ওসমানী বিমানবন্দরেই জব্দ করা হয়েছে ১৭৩ কেজি স্বর্ণ। মণ হিসেব করলে এর পরিমাণ দাড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ মণ। জব্দকৃত স্বর্ণের বাজারমূল্য ১৮২ কোটি ৯২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
অনুসন্ধান বলছে , ওসমানী বিমানবন্দর ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একটি স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্র। চক্রটি তাদের নিজস্ব ক্যারিয়ার বা বহনকারীদের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত দুবাই, আবুধাবীসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ে আসছে। চক্রটি সৌদি আরব থেকেও মাঝে মধ্যে স্বর্ণের ছোট ছোট চালান নিয়ে আসে।
এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আটক হওয়া চোরাচালানের মধ্যে বেশিরভাগ চালানই দুবাই থেকে নিয়ে আসা হয়। যাত্রী বেশে নানান কৌশলে স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ে আসা হলেও মূলত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিয়ে আসা হয়। আর এক্ষেত্রে স্বর্ণ চোরাচালানিদের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আর এক্ষেত্রে ওসমানী বিমানবন্দরের কতিপয় কর্মকর্তার সাথেও লেনদেনের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা সখ্যতা গড়ে তুলেছে। ওসমানী বিমানবন্দর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, কাস্টমসসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও অর্থের বিনিময়ে চোরাকারবারিদের সহযোগিতা করেন বলে সূত্র জানিয়েছে। যার ফলে সবসময়ই কেবল স্বর্ণ বহনকারী ধরা পড়লেও স্বর্ণের মূল মালিক বা চোরাকারবারিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
সিলেটের ডাক’র পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওসমানী বিমানবন্দরে গত বৃহস্পতিবার থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৭৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে ওসমানী বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা দুই যাত্রীর কাছ থেকে সাড়ে ১৭ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই সদস্যরা। জব্দকৃত স্বর্ণের বাজারমূল্য ২০ কোটি ২৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এসময় স্বর্ণসহ তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার রকমপুর গ্রামের হাসিব আলীর পুত্র সায়েদ আহমদ (২৪) ও সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার দরবার পূর্ববাইট গ্রামের মো. আলাউদ্দিনের পুত্র আফতাব উদ্দিন (৩৬)।
দুবাইর শারজাহ থেকে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটে (ফ্লাইট নম্বর- বিজি-২৫২) সায়েদ আহমদ ও আফতাব উদ্দিন ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। পরে তারা দ্রুত গতিতে বিমানবন্দরের গ্রীন জোন চ্যানেল দিয়ে স্বর্ণ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। ঠিক ওই সময় এনএসআই সদস্যরা বিমানবন্দরের পার্কিং থেকে তাদের আটক করে ভেতরে নিয়ে যান এবং তাদের কাছে থাকা ইলেক্টনিক ডিভাইস থেকে স্বর্ণের এই বিশাল চোরাচালান জব্দ করা হয়। চলতি বছর এটিই ওসমানী বিমানবন্দরে প্রথম জব্দকৃত স্বর্ণ চোরাচালান। এ ঘটনায় এয়ারপোর্ট থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
এয়ারপোর্ট থানার ওসি সৈয়দ আনিসুর রহমান গতকাল বুধবার সিলেটের ডাককে বলেন, স্বর্ণসহ গ্রেফতারকৃত দু’জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এজন্যে আদালতে রিমান্ডের আবেদনও জানানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। স্বর্ণ চোরাকারবারিদের ধরতে পুলিশ মাঠে কাজ করছে বলে তিনি দাবি করেন।
এদিকে, গত ৬ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে (বিজি-২৪৮) পরিত্যক্ত অবস্থায় সিটের নিচ থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চোরাচালান জব্দ করা হয়। জব্দকৃত স্বর্ণের দাম ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ওই ঘটনার ঠিক দু’দিন আগে ৪ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা একই ফ্লাইটে (বিজি-২৪৮) ১ কেজি ২৮৩ গ্রাম ওজনের ১১টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়েছিল। যার বাজার মূল্য ১ কোটি ৩৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
এর আগে গত বছরের ২৮ আগস্ট বুধবার সকালে শারজাহ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে (বিজি ২৫২) আসা যাত্রী হোসাইন আহমদের লাগেজে তল্লাশি চালিয়ে ১৫ কেজি ৯১৫ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত স্বর্ণের বাজার মূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা। স্বর্ণসহ গ্রেফতারকৃত হোসাইন আহমদ সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল বাজার এলাকার গোরামারাকান্দি গ্রামের নুরুল ইসলামের পুত্র।
২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ নম্বর ফ্লাইটের চার যাত্রী ও বিমানের টয়লেট থেকে ৩২ কেজি ৬৫ গ্রাম ওজনের ২৮০ টি বার ও দেড় কেজি ওজনের ৬টি লিকুইড গোল্ড জব্দ করে কাস্টমস। এ ঘটনায় সম্পৃক্ত বিমানের চার যাত্রী হাবিবুর রহমান (৩৮), মো. সানু মিয়া (৩৫), মো. আক্তারুজ্জামান (৪০) ও মিসফা মিয়াকে (৪৯) গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় চোরাচালান আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
এরও আগে ২০২২ সালের জুন মাসে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুটি চোরাচালান ধরা পড়ে। ২ জুন দুবাই ফেরত যাত্রী ময়নুল ইসলাম শাকিলের কাছ থেকে ১ কেজি ১৬০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২৭ মে আলী আহমদ নামের আরেক যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সমপরিমাণ স্বর্ণ।
২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি ২২০ গ্রাম স্বর্ণসহ দুবাই থেকে আসা চার যাত্রীকে আটক করে কাস্টমস। এই চার যাত্রী ব্লান্ডার মেশিন ও আয়রণ মেশিনের ভেতরে কৌশলে এই স্বর্ণ নিয়ে আসেন।
ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুবাই ফেরত যাত্রী নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৬ কেজি ১৪৮ গ্রাম ওজনের ৩৮ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরে নরেন্দ্র নাথকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা জামিল আহমদ (২৮) নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৪টি স্বর্ণের বার ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় দুই কেজি। যার দাম প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১২টি বার বিশেষ ব্যবস্থায় জামিলের উরুতে আটকানো ছিল।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী থেকে আসা জাহিদ হোসেন নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা।
একই বছরের ৩ জানুয়ারি ফ্লাই দুবাই দিয়ে আসা একটি ফ্লাইটে তল্লাশী চালিয়ে ৬০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় ৭ কেজি। যার দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট কামরুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৭ সালের ২৩ জুলাই আবুধাবি থেকে আসা বিমানের লাগেজ হোল্ডে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ৩০ টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। বিমানের ওই ফ্লাইটটি সিলেট হয়ে ঢাকায় ফিরছিল। স্বর্ণের এই চালান আটক করা হলেও এর সাথে জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন ১ কেজি ৮৭২ গ্রাম। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। একই বছরের ১৬ নভেম্বর ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের আসনের নিচে তল্লাশী চালিয়ে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। দুবাই থেকে আসা ওই বিমানের দুটি সীটের নীচ থেকে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়। তবে, এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনী।
ওই বছরের ১৭ মার্চ ৫৮০ গ্রাম ওজনের ৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায়ও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। ২৪ এপ্রিল এক লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে ৪৩২ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। পরে ব্যাগেজ রুলস মোতাবেক এর নিষ্পত্তি করা হয়।
২০১৫ ও ২০১৪ সালে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১৯ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। এছাড়াও প্রায়শই ১০০ ও ২০০ গ্রাম স্বর্ণ আটক, শুল্কায়ন, ন্যায় নির্ণয়নের ঘটনা ঘটছে বলে কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে।