বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবস : মেধা পাক তার যোগ্য প্রাপ্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ৩:৩৩:৩২ অপরাহ্ন

সেলিম আউয়াল :
আজ বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবস। প্রতি বছরের ২৬ শে এপ্রিল এই দিবসটি পালিত হয়। জাতিসংঘের বিশ্ব মেধা সম্পদ সংস্থা ২০০০ সালে প্রথম বারের মত দিবসটি পালন করেছিলো। বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবস পালনের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা পৃথিবীতে উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা ও মেধাসম্পদের গুরুত্বকে তুলে ধরা।
মেধা সম্পদ সম্পর্কে অনেকের সুস্পষ্ট ধারণা না থাকতে পারে। মেধা সম্পদ হচ্ছে- মানুষের ভাবনাজাত সৃষ্টি। প্রাকৃতিকভাবে যে সকল সৃষ্টি আছে, এর বাইরে বস্তুজগতে আমরা যা কিছুই দেখি না কেন মুলত সবকিছুই মানুষের মেধার ফসল। মানুষ তার মেধা খাটিয়ে এইসব সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এরপরও সারা পৃথিবীতে কিছু বিশেষ কাজকে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন উদ্ভাবন, সাহিত্য ও শৈল্পিক কর্ম এবং ব্যবসায়ে ব্যবহৃত প্রতীক, নাম ও ইমেজ বা ছবি। সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, মেধা সম্পদের পরিসীমাও তেমনি বাড়ছে। বিশ্বসমাজ মেধাবৃত্তিক সম্পদকে প্রধানত দুটো শাখায় ভাগ করেছে। এর একটি হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিয়েল প্রোপার্টি বা শিল্প সম্পদ এবং অপরটি হচ্ছে কপিরাইট। ইন্ডাস্ট্রিয়েল প্রোপার্টি বা শিল্প সম্পদের মধ্যে রয়েছেÑ পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন বা শিল্প নকশা এবং জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা ভৌগলিক লক্ষণ-পরিচিতি।
মেধাবৃত্তিক সম্পদের অপর শাখা কপিরাইট বলতে মূলত শৈল্পিক সৃষ্টিকর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডকে বোঝানো হয়। কপিরাইটের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছেÑউপন্যাস, কবিতা ও নাটক, চলচ্চিত্র সঙ্গীতসহ সাহিত্যকর্ম, ড্রয়িং, পেইন্টিং, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য নকশাসহ নান্দনিক কর্ম এবং প্রযুক্তিনির্ভর কাজ অর্থাৎ কম্পিউটার প্রোগ্রাম ও ইলেকট্রনিক ডেটাবেইজ। কপিরাইট সংশ্লিষ্ট অধিকারের মধ্যে রয়েছে শিল্পীদের বা পারফরমারদের অধিকার, ফনোগ্রাম প্রযোজকদের অধিকার, রেডিও বা টেলিভিশন সম্প্রচার সংস্থার অধিকার।
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আলোচনায় ইন্ডাস্ট্রিয়েল প্রোপার্টি বা শিল্পসম্পদ এবং কপিরাইটের মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে, তা আমাদের জানা দরকার। এই পার্থক্যটা হচ্ছেÑ পুরো দুনিয়া জুড়ে শিল্পসম্পদের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন বাধ্যতামুলক। অন্যদিকে কপিরাইট আনুষ্ঠানিকতা বিবর্জিত অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন বাধ্যতামুলক নয়, এটি হচ্ছে ঐচ্ছিকÑএকজন ইচ্ছে করলে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে অথবা করবে না।
মেধাসম্পদ অধিকার অন্য যে কোন সম্পদ অধিকারের মতÑ এই অধিকার পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক বা কপিরাইটের যিনি স্বত্বাধিকারী তাকে তার কাজ বা বিনিয়োগ থেকে লাভবান হওয়ার সুবিধে প্রদান করে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে এসব অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। এ ধারায় কোনো বৈজ্ঞানিক, সাহিত্য বা নান্দনিক সৃষ্টির মালিকানা থেকে উদ্ভুত নৈতিক ও বস্তুগত স্বার্থ সংরক্ষণ থেকে পাওয়া সুফল ভোগের অধিকারের বিষয়টি ঘোষিত হয়েছে।
মেধা সম্পদের গুরুত্বের বিষয়টি প্রথম স্বীকৃত হয় ১৮৮৩ সালে অনুষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি সুরক্ষার প্যারিস সম্মেলন, প্যারিস কনভেনশন ফর দা প্রটেকশন অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রপার্টি এবং ১৮৮৬ সালে অনুষ্ঠিত সাহিত্য ও শৈল্পিক কর্ম সুরক্ষার বার্ন সম্মেলনে ‘বার্ন কনভেশন ফর দা প্রটেকশন অব লিটারারি এন্ড আর্টিস্টিক ওয়ার্কস’। উভয় চুক্তিই পরিচালনা করছে বিশ্ব মেধা সম্পদ সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে ডব্লিউ আই পি ও।
মেধা সম্পদ প্রসার ও সংরক্ষণের কতগুলো যৌক্তিক কারণ রয়েছে। প্রথমত মানব জাতির অগ্রগতি ও কল্যাণ নির্ভর করে প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক জগতে নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষমতার উপর। দ্বিতীয় এ জাতীয় নতুন সৃষ্টিকর্মগুলোর আইনি সুরক্ষা এ খাতে অতিরিক্ত সম্পদ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, যা আরো নতুন নতুন সৃষ্টিকর্মের সম্ভাবনা তৈরি করে। তৃতীয়ত, মেধাসম্পদের প্রসার ও সংরক্ষণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে, নতুন চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে।
একজন স্রষ্টা তার সৃষ্টিকর্ম থেকে কতো বছর অর্থনৈতিক সুবিধে ভোগ করবেন, ১৮৮৬ সালের বার্ন কনভেনশনে তার একটি সময় নির্ধারণ করা আছে। বার্ন কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী সাহিত্য ও শিল্পকলাধর্মী কাজের জন্যে স্রষ্টার জীবনকাল এবং তার মৃত্যুর পর স্রষ্টার বৈধ উত্তরাধিকারীরা অতিরিক্ত পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত আর্থিক সুবিধে পেয়ে থাকেন। বার্ন কনভেনশনে আর্থিক সুবিধে পাবার মৃত্যুপরবর্তী সময়সীমা পঞ্চাশ বছর নির্ধারণ করা হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই সময়সীমা তাদের নিজেদের জাতীয় আইন দ্বারা নির্ধারণ করে বাড়িয়েছে।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে মেধা সম্পদ। এই মেধা সম্পদের সম্ভাবনা উপলদ্ধির মাধ্যমে একটি কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত মেধা সম্পদ ব্যবস্থা পৃথিবীর সবগুলো দেশকে সহায়তা করতে পারে। এই ব্যবস্থা উদ্ভাবকের স্বার্থ ও জনস্বার্থের মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এ ছাড়া কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত মেধা সম্পদ ব্যবস্থা এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি করে যেখানে সবার মঙ্গলের জন্যে সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবন বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।
নতুন উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশই মেধাসম্পদ। আর এ উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা যত বেশি জ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাতে পারবো, আমরা ততোই সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবো।
আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় মেধাসম্পদের কৃতিস্বত্ব (পেটেন্ট), কপি রাইট, বাণিজ্যিক মার্কা (ট্রেডমার্ক) এবং ঔদ্যোগিক ডিজাইনের প্রভাবের বিষয়ে সচেতন করে তোলা বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবসের মুল উদ্দেশ্য। একই সাথে সৃষ্টিশীল প্রতিভার উদযাপন করা এবং সমাজের উন্নয়নে অগ্রণী অবদানের জন্যে সৃষ্টিকর্তা ও উদ্ভাবকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবসে আরেকটি বিষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, সেটা হচ্ছে পাইরেসি। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সকল শিক্ষিত মানুষই পাইরেসি-এই ইংরেজি শব্দটির সাথে পরিচিত। পাইরেসি শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছেÑগ্রন্থাদির স্বত্ব লঙ্ঘন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে পাইরেসি শব্দের অর্থমান অনেক অনেক সম্প্রসারিত। এখন পাইরেসি বলতে শুধু গ্রন্থস্বত্ব লঙ্ঘনকেই বুঝায় না, অনুমোদন ছাড়া যে কোনো শিল্পকর্মের উৎপাদনই হচ্ছে পাইরেসি। এই পাইরেসির কারণে কর্মের রচয়িতা রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, পাঠক বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত জ্ঞান থেকে আর সরকার হারাচ্ছে তার রাজস্ব।
আমাদেরকে কপিরাইট রক্ষায় ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ কপিরাইটের সাথে সৃষ্টিশীলতার একটি নিবিড় সখ্যতা রয়েছে। একজন লেখকের বই তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ যেন প্রকাশ করতে না পারে অথবা একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম যাতে তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। অনুমতি ছাড়া শিল্পকর্মের পুনরুৎপাদন ও ব্যবহার চুরি হিসেবে গণ্য হবে। সৃষ্টিশীল মেধা সম্পদ যদি কেবলই চুরি হতে থাকে, তাহলে দেখা যাবে একদিন সেই সৃষ্টিশীল মানুষগুলো হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার আরোধ্য শিল্প সৃষ্টি থেকে, অথবা তারা পাড়ি জমিয়েছেন অন্য কোনো একটি দেশে। এটি হলে আমরা মেধাশূণ্যতার শিকার হবো। মোটা বুদ্ধির ভারে আক্রান্ত হবে দেশ। কেবলই পরনির্ভরশীল হয়ে থাকবো আমরা। অন্যের সম্পদ ধার করে বা চুরি করে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া যায় না এটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে।
তাই বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবসে আহবান, কপি রাইটের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা যেন সৃষ্টিশীল মানুষের পাশে দাঁড়াই এবং পাইরেসিকে ‘না’ বলি। মেধা পাক তার যোগ্য প্রাপ্য, তাহলেই সৃষ্টিশীল মানুষের জন্ম হবে বার বার, সৃষ্ট হবে অসংখ্য নতুন নতুন উদ্ভাবন আর সৃষ্টিশীল কর্ম।
লেখক : সাংবাদিক, গল্পকার।