লাল গ্রহে অভিযান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুন ২০২১, ১১:২০:৪৪ অপরাহ্ন

নূসরাত জাহান নিশা
নিজের চাকাগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিল পারসেভারেন্স। বলল, ‘কী দিয়ে বানিয়ে দিয়েছ? বেশ মজবুত মনে হচ্ছে’ বিজ্ঞানী ফটেং বলল, ‘হ্যাঁ অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে বেশ মজবুত করে বানানো হয়েছে। তোমার ছয়টা চাকা দিয়ে মঙ্গল গ্রহের রাস্তায় ঠিকঠাক যেন চলতে পার এ জন্য।’ পারসেভারেন্স প্রশ্ন করল, ‘কেন? মঙ্গলের রাস্তা কি খুব খারাপ?’ বিজ্ঞানী পুটু বলল, ‘অনেক খারাপ। আঁকাবাঁকা, খড়খড়ে, ধুলোমাটি আর পাথরে ভরা। তোমার চাকা যদি মজবুত না হয় তাহলে ওগুলো ছিঁড়ে ফেটে যাবে।’
‘হুম, এবারের অভিযানটা বেশ জমবে মনে হচ্ছে।’ বলল পারসেভারেন্স। ‘ভালো হতেই হবে। তোমাকে সেভাবেই সাজিয়ে দিচ্ছি। তোমাকে খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে হাজার কোটি বছর আগে মঙ্গল গ্রহে প্রাণের কোনো চিহ্ন ছিল কি না, পানি ছিল কি না।’ বলল বিজ্ঞানী মং। তাদের কথা শুনে পারসেভারেন্স বলল, ‘ছয়টা চাকা দিয়ে কিছু হবে? পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আরো কত কী লাগে।’
‘একটু বসো বাপু। সঙ্গে আরো আটটা যন্ত্র সেট করে দেব। এগুলো দিয়ে লাল গ্রহে অনুসন্ধান চালাবে।’ বলল বিজ্ঞানী নোরা। ‘লাল গ্রহ? সেটা আবার কী? বলল পারসেভারেন্স। ‘আমরা মানুষরা মঙ্গল গ্রহকে লাল গ্রহ বলি; কারণ দূর থেকে মঙ্গল গ্রহের রং লাল দেখায়।’ বলল বিজ্ঞানী ফটেং। ‘তাই বলো’ বলল পারসেভারেন্স।
বিজ্ঞানী মং, ফটেং, পুটু আর নোরা প্রাণপণ খেটে যাচ্ছে। আর কিছুদিন পরই পারসেভারেন্সকে রকেটে করে পাঠানো হবে মঙ্গলে।
‘একটা আয়না হবে?’ জানতে চাইল পারসেভারেন্স। ভ্রু কুঁচকে তাকাল সবাই। ‘আরে আমি দেখতে কেমন হয়েছি সেটা একটু দেখতে চাই।’ বলল পারসেভারেন্স। হাজির হলো বিশাল আয়না। বিজ্ঞানী নোরা বলল, ‘তুমি দেখতে অতিকায় এক পিঁপড়ার মতো। পিঁপড়ার মতো ছয়টা পা আছে তোমার।’
‘বাকি যন্ত্র লাগাতে হবে ওর গায়ে।’ বলল বিজ্ঞানী মং। একে একে আটটা যন্ত্র বসানো হলো। নামিয়ে রাখল পারসেভারেন্সের সামনে। এত এত যন্ত্রপাতি দেখে আঁতকে উঠল পারসেভারেন্স।
‘কোনটার কী কাজ বুঝতেই পারছি না।’ নোরা বুঝিয়ে দিল, ‘তোমার ঘিলুতে সব বুদ্ধি দিয়ে দেওয়া হবে। নিজে থেকেই বুঝতে পারবে সব।’
এই যেমন ‘সুপারক্যাম’ মঙ্গল গ্রহে ২০ ফুট দূর থেকে মাটি ও পাথরের গঠন পরীক্ষা করবে। ‘মাস্টাক্যাম-জেড’ এই যন্ত্রের সাহায্যে মঙ্গল গ্রহে খনিজ পদার্থ আছে কি না তা খুঁজে দেখবে। ‘মেডা’ এটা দিয়ে মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা কেমন, বাতাসের গতি, আদ্রতা, ধুলোর আকার পরীক্ষা করা হবে। আরেকটা আছে ‘শেরলক’। কোটি বছর আগে কী কী অণুজীব ছিল কী না মঙ্গল গ্রহে তা খুঁজে বের করবে ওটা। ‘পিক্সেল’ যন্ত্রটি ক্ষুদ্র রাসায়নিক মৌলের সন্ধান করবে। মঙ্গলের মাটি ১০ মিটার খুঁড়ে দেখবে পানি বা বরফ আছে কি না ‘রিমফ্যাক্স’ যন্ত্রটি। ‘মক্সি’র কাজ হবে মঙ্গল গ্রহের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন তৈরি করা।
হাঁ করে শুনল পারসেভারেন্স। মাথা নাড়াল। বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। আমার গায়ে যন্ত্রগুলো লাগিয়ে দাও।’ লাগিয়ে দেওয়া হলো। বিজ্ঞানী মং সর্বশেষ যন্ত্রটি নিয়ে এলো। পারসেভারেন্স অবাক হয়ে প্রশ্ন করল কী এটা? মং বলল, ওর নাম হলো ‘ইনজেনুয়িটি’। ওটা একটা ড্রোন। পারসেভারেন্স বলল, ‘ওটা কী করে?’ মং বলল, ‘ইনজেনুয়িটি মঙ্গলের আকাশে উড়বে। এতে আছে কার্বন ফাইবারের তৈরি চারটি পাখা। মিনিটে আড়াই হাজারবার ঘুরতে পারে। মাটিতে দাঁড়ানোর জন্য আছে চারটি পা। পায়ে লাগানো থাকবে চারটি ক্যামেরা। আর আছে একটি কম্পিউটার। ওটাই দেবে দিকনির্দেশনা।’
অবশেষে রওনা দিল পারসেভারেন্স। ওকে ভরা হয়েছে একটি সাদা গোলাকার ক্যাপসুলে। ওটা ওকে বয়ে নিয়ে গেল মঙ্গলে।
মঙ্গলের বুকে নামতে গিয়ে পারসেভারেন্সকে একটু ঝামেলাও পোহাতে হয়েছিল। একটু এদিক-সেদিক হলেই সব ভেঙেচুরে যেত। ওর পৌঁছানোর খবর জানতে বিজ্ঞানীদের লেগেছিল সাত মিনিট। এই সাত মিনিট পারসেভারেন্সকে চলতে হয়েছিল নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে। পারসেভারেন্স প্রস্তুতি নিল ‘ইডিএল’র জন্য। ‘ই’ এন্ট্রি, মানে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে নিরাপদে ঢোকা। ‘ডি’ মানে ডিসেন্টমানে ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে গ্রহে নামা এবং ‘এল’ ল্যান্ডিং। এর মানে তো বোঝোই, মানে দুলকি চালে মঙ্গলের মাটিতে পা রাখা।
মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ঢুকে ক্যাপসুলটির গতি কমানোর জন্য লাগানো ছিল একটি বিশাল প্যারাশুট; ওটাই ধীরে ধীরে পারসেভারেন্সের গতি কমাল। গতি কমাতে সাদা ক্যাপসুলের ভেতর পারসেভারেন্সের সঙ্গে ছিল একটি স্কাইক্রেনও। ওটারও আছে চারটা পা। ওপরে ভাসতে ভাসতেই কয়েকটি শক্ত তার দিয়ে পারসেভারেন্সকে নিচে সাবধানে নামিয়ে দিয়েছে ওটা। মঙ্গলে নেমেই পৃথিবীতে বিজ্ঞানীদের কাছে ছবি পাঠাতে শুরু করে পারসেভারেন্স। আর তা দেখে কী খুশি মং, ফটেং, পুটু ও নোরা। গ্রহের বিষুব অঞ্চল যার নাম জেযেরো, ওটার পাশে একটি গভীর গর্তের কাছে নেমেছে পারসেভারেন্স। কয়েক শ কোটি বছর আগে বিশাল একটা হ্রদ ছিল ওটা। সম্ভবত তখন পানিতে ভরপুর ছিল। হয়তো প্রাণীও ছিল। পারসেভারেন্স মঙ্গলে পৌঁছানোর সপ্তাহখানেক পর বিজ্ঞানীরা ‘ইনজেনুয়িটি’কে প্রথমবারের মতো মঙ্গলের আকাশে ওড়াতে পেরেছে। ‘ইনজেনুয়িটি’ ১০ ফুট উচ্চতায় উড়তে পেরেছে। দৃশ্যটা ধরা পড়েছে পারসেভারেন্সের ক্যামেরায়। আর তাতেই ঘটে গেল ইতিহাস। পৃথিবীর বাইরে প্রথম কোনো ড্রোন ওড়াতে পারল বিজ্ঞানীরা। পারসেভারেন্স আর কী কী চমক দেখায় এখন তার অপেক্ষায় আছে তারা।