কোম্পানীগঞ্জের ধলাই সেতু
বালুখেকোরা নিশ্চিহ্ন করছে এম সাইফুর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫:৫৪:৪৫ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ।। আবিদুর রহমান:
এই ব্রিজটা পূর্বপাড়বাসীর মেরুদণ্ড। এটা ভেঙে গেলে পশ্চিমপাড়ের মানুষের কিছুই হবে না। কিন্তু আমরা পূর্বপাড়বাসী সেই সনাতন আমলের তো আতুড় হয়ে যাব। কষ্ট আমাদের প্রত্যেকেরই হবে।
আমাদের মুমূর্ষু রোগী, গর্ভবতী নারী, সাধারণ শ্রমিক,চাকুরিজীবী, আমলা, কামলা, শিশু-কিশোরসহ সব ধরনের মানুষকে খেয়া পারাপারের ঝামেলায় পড়তে হবে।
শুধু এটা না, তখন এই ব্রিজের দোহাই দিয়ে মুদি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবজি ব্যবসায়ী, মাছ ব্যবসায়ী, তেল ব্যবসায়ী, পান ব্যবসায়ীসহ সব ধরনের ব্যবসায়ীই আমাদের গলা কাটবে। ক্ষমতাশালীরা এখন যেরকম দামি দামি মোটর চড়ে ব্রিজ লুটপাটে মেতে আছেন; তখন কিন্তু ধনী-গরিব কারো কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সবাইকে লুঙ্গি মাথায় দিয়ে অথবা সাঁতার কেটে জেলা উপজেলায় যেতে হবে। সেদিন আপনার দামি গাড়িটা ওপারেই থাকবে, আর এ পারে আনতে পারবেন না!
তাই পূর্বপাড়ের একজন বাসিন্দা হিসেবে সকল ব্যবসায়ীর কাছে অনুরোধ করি, আপনারা আমাদের মেরুদÐটা জীবিত রাখুন। দয়া করে গরিব বাঁচার দোহাই দিয়ে আমাদের মেরুদÐটা আর ভাঙবেন না। আল্লাহর ওয়াস্তে এবার থামেন।’
কোম্পানীগঞ্জের ধলাই সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলন নিয়ে ফেসবুকে এমন আবেগঘন স্ট্যাটাস মালয়েশিয়া প্রবাসী ও পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ইয়ামিন আরাফাত ইয়ামিনের। কেবল ইয়ামিনই নয়, সেতুটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ধলাই নদীর পূর্বপারের বেশীরভাগ বাসিন্দা।
ওই এলাকার ইকবাল হোসেন নামের আরেক বাসিন্দা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ধলাই সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলন চলছেই। বালু কারবারীরা বেপরোয়া। কারও তোয়াক্কা তারা করে না। নির্বিঘেœ চলছে সব। প্রশাসন এখানে নির্বিকার। অভিযান হয়। কিন্তু পরক্ষণেই শুরু হয়ে যায় বালু উত্তোলন। সেতু রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন জোরালো হয়নি। শ্রমিকবিরোধী ‘তকমা’ দিয়ে আন্দোলনকারীদের থামানো হয়েছে। সেতুর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।
সরেজমিন ঘুরে আমাদের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, সেতুর গোড়া থেকে অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। শতাধিক বারকি নৌকায় লোড করা হয় বালু। পরে নদীর পাড়ে স্তূপ করে রাখা হয়। সেখান থেকে ছোট ছোট ট্রলি এবং ট্রাক্টরে করে নেওয়া হয় বিভিন্ন ক্রাশিং মিলে। সেতুর নিচ এবং ৫০ থেকে ২০০ গজের মধ্যে বালু উত্তোলনের ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে সেতুটি। ইতোমধ্যে সেতুর পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরে গিয়ে গর্ত তৈরি হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, মাস দুয়েক ধরে এই অবৈধ কারবার চলছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়েও বালু কারবারীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সেতুটির সাথে সিলেট বিভাগের উন্নয়নের রূপকার, সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ২০০১ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় এম সাইফুর রহমান বর্ষায় খরস্রোতা ধলাই নদীতে ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। এমপি নির্বাচিত হবার পর প্রি-একনেকের মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগকে দিয়ে ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু করে দেন।
২০০৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ব্রিজটি চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয়। সে সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেতুটি এম সাইফুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে পূর্বপাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এম সাইফুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত ওই ব্রিজটি টিকিয়ে রাখতে তারা সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে বার বার যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উপরন্তু, দিনে দিনে বালু খেকোরা আরো সক্রিয় হয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি স্থাপনার নিচ থেকে বালু উঠাচ্ছে।
মানুষের অপরিণামদর্শী এ কার্যক্রমের ফল পূর্বপাড়ের বাসিন্দাদের ভুগাবে বলে তাদের মন্তব্য। মরহুম এম সাইফুর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন বাঁচিয়ে রাখার আকুতি জানিয়ে তারা বলেন, বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য থামাতে প্রশাসনিক উদ্যোগ খুবই জরুরি।