চাঁদাবাজিতে নতুন মুখ, দীর্ঘদিনের বদঅভ্যাস থেকে বের হতে সময় লাগবে : এসএমপি কমিশনার
ফুটপাত তুমি কার?
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মার্চ ২০২৫, ১:৫৯:৩০ অপরাহ্ন

আহমাদ সেলিম :
সিলেট নগরীর ভেতর গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো ফুটপাত দখল করে আবারো বেড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। এই দখলবাজির পেছনে শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। ঈদকে সামনে রেখে সেই সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদের দমাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না সিটি কর্পোরেশন কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফুটপাত বেদখলে রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠনের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের কিছু কর্মকর্তা সহায়তা করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি-কোনো সরকারের আমলেই ফুটপাত দিয়ে মানুষের নির্বিঘ্নে চলাফেরার বিষয়টি নিশ্চিত হলো না। তারপর দেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরও সিলেট নগরীর ভেতরে ফুটপাত, চাঁদাবাজ, দখলবাজ- আগের মতোই রাজত্ব কায়েম করছে। পরিবর্তন হয়েছে শুধু চেহারায়। আগে যে জায়গায় ছিলো আওয়ামী লীগ, এখন সেখানে এসেছে নতুন মুখ। নগরীর ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের প্রশ্ন, সেই নতুন মুখগুলো কারা?
হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সিলেটের সবকটি ফুটপাত ছিলো আওয়ামী লীগ নেতাদের কব্জায়। প্রায় চার শতাধিক অস্থায়ী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা গুনতেন সরকারদলীয় নেতারা। সেই টাকার ভাগ যেতো বহুল আলোচিত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি থেকে শুরু করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটেও। প্রতিদিন অন্তত পাঁচ লক্ষ টাকা আদায় করা হতো ফুটপাতের ১৫ থেকে ২০টি পয়েন্ট থেকে। সেই টাকাগুলো অবশ্য নেতাকর্মীদের মাধ্যমে না তুলে দালালদের (লাইনম্যান) মাধ্যমে সংগ্রহ করা হতো। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে, বন্দরবাজার, লালদিঘীরপাড়, কোর্ট পয়েন্ট, তালতলা, আদালতপাড়া, রাজা ম্যানশন এলাকার ফুটপাত থেকে টাকাগুলো তুলতো সেই দালাল সিন্ডিকেট। তবে একটা সময় সেই ব্যবসায়ীরা ফুটপাত থেকে লালাদিঘীরপাড়ের ভেতর সিটি কর্পোরেশন নির্মিত স্থায়ীবাজারে ব্যবসা করতে বাধ্য হন।
কিন্তু, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লালদিঘীরপাড়ের ভেতরে থাকা ব্যবসায়ীরা আবার রাস্তায়, ফুটপাতে চলে আসেন। এখনো তারা সবগুলো ফুটপাত দখল করে রেখেছেন। বরং আগের চেয়ে বর্তমানে ফুটপাতের সংখ্যাও বেড়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
ক্ষুদ্র স্থায়ী-অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের ফুটপাত দখল করে বসার সুযোগ করে দিতে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার চাঁদাবাজির অভিযোগে মহানগর যুবদলের এক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কার করার পরও চাঁদাবাজি থেমে নেই। বরং ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি আরো বেড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সিলেটের সুশীল সমাজের একটি মহল মনে করছেন, চাঁদাবাজরা যদি আওয়ামী লীগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে, তবে তাদেরকে জনগণ গ্রহণ করবে না। সিলেট নগরীর সবগুলো ফুটপাত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো ফুটপাত এখন তাদের দখলে। নির্বিঘ্নে পায়ে হাঁটারও সুযোগ নেই। এমনকি শিশুরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে, ঈদের কেনাকাটা করতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের চলার পথ সংকুচিত হয়ে পড়ায় জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, আম্বরখানা, রাজাম্যানশন এলাকায় বেড়েছে যানজট।
ফুটপাত না পেয়ে সড়কে নেমে হাঁটতে হচ্ছে নগরবাসীকে। তবে ফুটপাত দখলমুক্ত করার ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। মাঝে মাঝে চাঁদাবাজ কিংবা ফুটপাতের উপর গণমাধ্যমে খবর ছাপা হলে কিছু সময়ের জন্য তাদের টনক নড়ে। তখন মাইকিং করে ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার রেকর্ড করা পুরনো বয়ান প্রচার করা হয়। তারপর কিছু সময় পুলিশ কিংবা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের সাথে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ শুরু হয়। সিটি থেকে লোকজন এলে ব্যবসায়ীরা দৌড়ে পালায়। কিছু সময় পর আবার ফুটপাতে ফিরে আসে পুরনো চেহারায়।
নগরীর সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং সরকারি কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষার্থী ও বেশ কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে ফুটপাত দখল করে জুতার দোকান খোলা হয়েছে। দেখতেও লজ্জা লাগে আমাদের। দোকান গড়ে ওঠার কারণে স্কুল চলাকালে শিক্ষার্থীদের চলাফেরায় নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
বন্দরবাজারে স্কুল শিক্ষক শফিকুর রহমান বলেন, ‘ফুটপাত দখলমুক্ত না হলে চাঁদাবাজি কোনোদিন বন্ধ হবে না। চাঁদাবাজরা কাঁচাটাকার লোভ সামলাতে পারবে না, এমনকি পুলিশও না।’
সিলেট নগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা হকারদের হাত থেকে ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত করে জনদুর্ভোগ লাঘবে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। রোববার বেলা আড়াইটায় এই স্মারকলিপি দেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি, সিলেট জেলা শাখা এবং সিলেট জেলা ও মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, “বিভাগীয় শহর সিলেটের ফুটপাত ও রাজপথ আজ চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় পতিত হয়েছে। গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী মহলের মদদে মহানগরীর লাখো মানুষ আজ ভাসমান হকারদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। হকারদের বেপরোয়া অবস্থানের কারণে সিলেট নগরী এখন যানজট, দুর্ভোগ আর অশান্তির নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রায়ই ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। নিরাপদে পথ চলার জন্য ফুটপাত থাকলেও তা হকারদের দখলে থাকায় পথচারী চলাচলে এক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় অবৈধ গাড়ি পার্কিং, দোকানপাটের সামনে মালামাল রাখা, সড়কে এলোমেলোভাবে নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা, হকারদের ইচ্ছেমাফিক বিচরণ গোটা নগরীকে যেন অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
বর্তমানে রাজপথের মাঝখানও দখলে নিয়েছে হকাররা। সেখানেও তারা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। ফুটপাত ও রাস্তায় যত্রতত্রভাবে হকাররা অবস্থান নেওয়ায় বিশেষ করে নারী-পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী, শিশু ও বৃদ্ধদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রায়ই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি আব্দুর রহমান রিপন বলেন, ‘ফুটপাত দখল সিলেটের ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আমাদের তিনদিনের সময় দেয়া হয়েছে। এর ভেতর ব্যবস্থা না নিলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সিলেট মহানগন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমদাদ চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হলেই আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে সেই কঠোরতা প্রয়োগও হয়েছে। তবে যে হারে অভিযোগ আসছে, সেটি সত্য নয়। বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে কোনো মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে কি না সেটি তলিয়ে দেখতে হবে আপনাদের।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, ‘বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ করছি। আমরা ফুটপাত উচ্ছেদ ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের উচ্ছেদ অভিযান নিয়মিত চলবে।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্মারকলিপি পাইনি। তবে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
এ প্রসঙ্গে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। চাঁদাবাজি, দখলবাজি বন্ধে আমাদের স্পেশাল টিম কাজ করছে। ঈদের আগ পর্যন্ত সেই টিম মাঠে সার্বক্ষণিক কাজ করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছু যে পরিবর্তন হচ্ছে না, সেটিও বলা যাবে না। তবে, দীর্ঘদিনের বদঅভ্যাস থেকে বের হতে সময় লাগবে।’