বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতার নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হলো: মুশফিকুল ফজল
সিলেট থেকে স্পেনে উড়াল দিল প্রথম কার্গো ফ্লাইট
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫:৪২:২৪ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার: ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিদেশে পণ্য রপ্তানির সুবিধা (ট্রান্সশিপমেন্ট) বাতিল করার পর সিলেট থেকে প্রথমবার সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালু করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও রপ্তানি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশিষ্ট জনেরা। তারা বলছেন, ভারতের বিমানবন্দর সুবিধা বাতিল করায় রপ্তানিতে যে প্রভাব পড়ার কথা বলা হচ্ছিল, ঘটেছে তার উল্টো। সিলেট থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালু করায় এখন আরও কম খরচে পণ্য রপ্তানি করা যাবে।
রোববার রাত ৮টা ১০ মিনিটে সিলেট থেকে ৬০ টন গার্মেন্টস পণ্য নিয়ে উড়াল দেয় একটি চার্টার্ড ফ্লাইট এ ৩৩০-৩০০। উড্ডয়নের আগে জলকামানে পানি ছিটিয়ে ফ্লাইটটির উদ্বোধন করা হয়। দুবাই হয়ে ফ্লাইটটি সরাসরি ইউরোপের দেশ স্পেনে পৌঁছাবে। এই বিমানবন্দর থেকে প্রতি সপ্তাহে দুটি ফ্লাইট পরিচালিত হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ভারতের বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা বন্ধ করায় এখন আরও কম খরচে বিদেশে পণ্য পাঠাতে সক্ষম হবো।
শেখ বশীর উদ্দিন বলেন, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধের পর যে সমস্যা হবে ধারণা করা হয়েছিল বা রপ্তানিতে যে প্রভাব পড়ার ধারণা করা হয়েছিলো তা কিছুই হয়নি। সুবিধা বন্ধের পর দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপে রপ্তানি খরচ কমেছে ৩৭ শতাংশ। আর যুক্তরাজ্যে ১৩ শতাংশ। এই খরচ কিভাবে আরও কমানো যায় সেটি চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।
পর্যটন উপদেষ্টা বলেন, এই কার্গো ফ্লাইট চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কার্গো সার্ভিস সক্ষমতা বৃদ্ধি হলো। আমরা দেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে সচেষ্ট হব।
উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন আরও বলেন, ভারতের বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা বন্ধ করায় যে সব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে-তা মোকাবিলার জন্য সরকার সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, কার্গো পরিষেবা আরও সাশ্রয়ী করতে শুল্ক সংশোধনের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা কার্গো খরচ এমন পর্যায়ে নিয়ে আসতে চাই যা ভারতের ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে রপ্তানি খরচের চেয়েও কম হবে।
উপদেষ্টা শেখ বশীর উদ্দিন বলেন, যে কারণেই আমাদের ব্যবসায়ীরা খরচের জন্য অন্য দেশের বিমানবন্দর ব্যবহার করতেন-এখন তার থেকে অনেক কম খরচে আমাদের দেশ থেকে কার্গো করতে পারবেন। ঢাকা থেকে ইউরোপে কার্গো খরচ ১৩ শতাংশ কমেছে। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে সমস্যার সমাধান করেছি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর আজই প্রথম ঢাকার বাইরে থেকে কার্গো ফ্লাইট শুরু হয়েছে। এটি সিলেটবাসীর জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু হওয়া নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বাণিজ্য ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমাদের সর্বক্ষেত্রে সক্ষমতা বেড়েছে। সাফল্য কোন গন্তব্য নয়, এটি একটি যাত্রা। আমরা আজকে যে সাফল্য অর্জন করলাম, এটি কোনোভাবেই গন্তব্য নয়, এটি একটি যাত্রা। ফ্যাসিস্ট সরকারের অনেক দায় আমাদের নিতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা এমন কোনো ব্যয় করতে রাজি না, যা কেবল খরচ বাড়াবে, উদ্বৃত্ত হবে না। কারণ এতে আমাদের দায় বাড়বে।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন,তারা উৎপাদনশীলতাকে ক্রিমিলাইজেশন করে সবকিছুতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের অর্জিত অনেক দায় তাদেরকে নিতে হচ্ছে।
উচ্চ বিমান ভাড়ার বিষয়ে আলোকপাত করে তিনি বলেন, বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোকে খরচা অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরিন জাহান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ আহমদ।
বক্তব্যে মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, সিলেটবাসীর প্রাণের দাবি ছিল একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। সিলেটবাসী এই দাবি নিয়ে হরতাল পর্যন্ত করেছেন। সিলেটবাসী দীর্ঘদিন থেকে বঞ্চিত ছিলেন। আজ কার্গো ফ্লাইটের যে যাত্রা শুরু হলো এটি অব্যাহত থাকলে সিলেটবাসী উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, সিলেটে উন্নয়নের নামে যে কমর্যজ্ঞ হয়েছিল ; তাতে লুটপাটের মহোৎসব হয়েছে। বর্তমান সরকার সেই লুটপাটের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা নিজেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে যাই। একসময় এই মালামালগুলো অন্যদেশে গিয়ে এই বিমানের কার্গো হতো। কিন্তু এখন আর অন্যদেশে যেতে হবে না, আমরা নিজেদের দেশ থেকেই কার্গো করব। আমি আশা করি, আপাতত সিলেট থেকে সপ্তাহে অন্তত ২টি কার্গো ফ্লাইট হবে।
হাইকমিশনার আনসারী বলেন, আমরা কারো ওপর নির্ভরশীল নই। সিলেট থেকে কার্গো ফ্লাইটে সরাসরি পণ্য পাঠানোর মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করছি আমরা পারি। এখন থেকে সিলেট থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক মার্কেটে পণ্য সরাসরি পাঠানো হবে। তিনি আরও বলেন, এই নতুন যাত্রা বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতার নতুন দিগন্ত উম্মোচিত করবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরিন জাহান বলেন, সিলেটবাসীর দাবি ছিল বিশ্বের সব দেশে সিলেট থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু করার। এটি আজ বাস্তাবায়ন হলো। সিলেট থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু হওয়ার ফলে ঢাকার উপর চাপ কমে যাবে। সিলেটে প্যাকিং হাউস স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারাই এই পথ বেছে নেন।’ এর মাধ্যমে উপদেষ্টা ব্যক্তি উদ্যোগে প্যাকিং হাউজ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূইয়া বলেন, আজ দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো। এর মাধ্যমে দেশের রাপ্তানিখাতে যুগান্তকারী উন্নতি হবে। আপাতত সিলেট থেকে সপ্তাহে দুটি কার্গো ফ্লাইট যাবে। আমরা ধীরে ধীরে এটি আরো বাড়াবো ইনশাআল্লাহ।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, আজ আমরা সিলেট থেকে পণ্যবাহী ফ্লাইট উদ্বোধন করলাম এবং আমরা শিগগিরই চট্টগ্রাম থেকে কার্গো ফ্লাইটে রপ্তানি শুরু করবো। আপাতত সিলেট থেকে প্রতি সপ্তাহে দুটি কার্গো ফ্লাইট যাবে। পরবর্তী বাজার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ফ্লাইট সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কার্গো টার্মিনাল উদ্বোধনের আগে সক্ষমতা বাড়াতে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। বিদ্যমান অবকাঠামো শিগগিরই দুই থেকে তিনগুণ বেশি পণ্য পরিবহনে সক্ষম হবে বলে মনে করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
ভুইয়া বলেন, সিলেট ও চট্টগ্রাম ছাড়াও, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনাল বাংলাদেশের রপ্তানি কার্গো সক্ষমতা বার্ষিক দুই লাখ টন থেকে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার টনে উন্নীত হবে।
সিলেটে প্যাকেজিং হাউসের স্বল্পতার বিষয়ে আলোকপাত করে তিনি বলেন, এ অবস্থায় পচনশীল দ্রব্য আমরা আপাতত এখান থেকে রপ্তানী করতে পারছি না। তবে, ব্যক্তি উদ্যোগে প্যাকিং হাউস নির্মাণের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাবো।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জিয়াউর রহমান চৌধুরী, সিলেট জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান, মহানগর জামায়াতের আমীর ফখরুল ইসলাম, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মুজিবুর রহমান মিন্টু,এফবিসিসিআই’র সাবেক পরিচালক খন্দকার সিপার আহমদ, বাংলাদেশ ফ্লাইট ফরওয়ার্ডারস এসোসিয়েশন (বাফা) সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সাব কমিটির চেয়ারম্যান হিজকিল গুলজার, সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি ইকরামুল কবির, সিনিয়র সহ-সভাপতি খালেদ আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, চেম্বারের সাবেক পরিচালক আলীমুল এহছান চৌধুরী, সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি খায়রুল হোসেন, সাবেক সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরী, যমুনা ওয়েল লিমিটেডের পরিচালক সালেহ আহমদ খছরু, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, এনসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য ব্যারিস্টার নুরুল হুদা জুনেদ প্রমুখ।