এক বছর ধরে ‘নিশ্চুপ’ ছিল প্রশাসন : পুলিশ
পাথর কান্ড : আতঙ্ক নয়, চিহ্নিত করতে হবে প্রকৃত দোষীদের
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১:৫৮:৪৩ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদাপাথর লুট নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নানামুখী রিপোর্ট এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সচেতন মানুষজন প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের দাবি তুললেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্থানীয়দের মতে, প্রকাশিত রিপোর্টে ‘নির্দোষ’ মানুষকেও জড়ানো হচ্ছে।
গত বুধবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এ ঘটনায় কাজ বৃহস্পতিবার জামায়াত ও এনসিপি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। অন্যদিকে মহানগর বিএনপিও বুধবার সাংবাদিকদের ব্রিফিং দেয়। তাদের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকের নাম রিপোর্টে যুক্ত করা হচ্ছে-যা প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে ফেলতে পারে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলের পাথর কোয়ারিগুলোতে যন্ত্রদানব ‘বোমা মেশিন’ ব্যবহার শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। তখন থেকেই শুরু হয় ভয়াবহ পরিবেশ ধ্বংস। শাহ আরপিন টিলা মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া, শ্রীপুর ও রাংপানি এলাকায় নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে প্রকৃতি ক্ষত-বিক্ষত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-এর রিটের প্রেক্ষিতে ২০২০ সাল থেকে কোয়ারিগুলোতে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়। পরবর্তীতে সনাতন পদ্ধতিতে কোয়ারি খোলার দাবিতে আন্দোলন হলেও উচ্চ আদালত থেকে অনুমোদন মেলেনি।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেট অঞ্চলের পাথর কোয়ারিগুলোতে প্রশাসনের নাগের ডগায় ফের নির্বিচারে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। ৫ আগস্টের অব্যবহিত পর বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন বাংলাদেশ রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। এলাকাটিকে বানানো হয় বিরানভূমি। নির্বিচারে বালু-পাথর উত্তোলনের ফলে সিলেট বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু ধলাই সেতুকে ফেলা হয় হুমকির মুখে। সাদাপাথর, জাফলং ও বিছনাকান্দি থেকে তখনও পাথর চুরি হতে থাকে। দৈনিক সিলেটের ডাকসহ জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকগুলোতে এ নিয়ে প্রকাশিত হয় সচিত্র প্রতিবেদন। তখন অভিযোগ উঠেছিল, সীমান্ত এলাকায় দায়িত্বরত পোশাকী বাহিনীকে ম্যানেজ করে দুর্বৃত্তচক্র পাথর উত্তোলন করছেন।
ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে ও ধলাই ব্রিজ রক্ষায় বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং ইউএনও’র কাছেও স্মারকলিপি দেয়া হয়। সে সময় ‘লোক দেখানো’ অভিযান পরিচালনা করা হলেও সিভিল কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি জোরালো কোনো পদক্ষেপ। সম্প্রতি উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে এলে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা থেকে নৌকা দিয়ে ‘পঙ্গপালে’র মতো পাথর লুট শুরু হয়। সাদাপাথর এলাকাকে পরিণত করা হয় বিরানভূমিতে। এরপর টনক নড়ে প্রশাসনের। সাদাপাথর রক্ষায় নেয়া হয় জোরালো পদক্ষেপ।
সাদাপাথর সংলগ্ন এলাকার একাধিক বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর নেতৃত্বেই মূলত পাথর লুট হয়েছে। কারা এর সাথে জড়িত নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় লোকজনের বিরুদ্ধে পাথর চুরির যে ঢালাও অভিযোগ আনা হচ্ছে, অতিরঞ্জিত রিপোর্টিং-কোয়ারি সংলগ্ন গ্রামসমূহের মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কোয়ারি সংলগ্ন গ্রামগুলো এখন পুরুষশূন্য। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকলক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকার অনেক নিরীহ লোকও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে ওইসব এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি মানবিক বিপর্যয়ও দেখা দিতে পারে বলে স্থানীয়রা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
অবশ্য, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার রেজা-উন-নবী খান গতকাল বুধবার কোম্পানীগঞ্জ পরিদর্শন করে বলেছেন, তদন্ত করে সাদাপাথর লুটের প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা হবে। কোন নিরীহ লোককে হয়রানি করা হবে না।
কিন্তু, বিভাগীয় কমিশনারের বক্তব্যের পরও স্থানীয় লোকজন আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে অজানা এক আতঙ্ক। এ আতঙ্ক দূরীকরণে উদ্যোগী হতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে।