টক অব দ্য সিটি
স্কলার্সহোমের শিক্ষার্থী দানিয়ালের মৃত্যুর দায় কার?
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৭:৩১:৪৩ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সিলেটের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলার্সহোম’র শিক্ষার্থী আজমান আহমেদ দানিয়াল (১৯) এর মৃত্যুর খবর বৃহস্পতিবার ছিল সিলেটের টক অব দ্যা সিটি। স্কলার্সহোম থেকে তাকে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) প্রদান এবং কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল আজমান ও তার পরিবারের সাথে দুর্ব্যবহারের কারণে কিশোর বয়সী ছেলেটি স্কলার্সহোমের ইউনিফর্ম পরেই আত্মহননের পথ বেছে নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় অনেকে স্কলার্সহোমের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথে সামনে আনতে শুরু করেছেন। এদিকে, স্কলার্সহোমের অভিভাবকরা শুক্রবার বাদ আছর আজমানের বাসায় গিয়েছেন। শিক্ষকদের ‘দুর্ব্যবহারের’ বিষয়টি সোস্যাল মিডিয়ায় আজমানের মায়ের প্রশ্ন, স্কলার্সহোম ‘আমার পুয়ারে বেইজ্জত করলো কেনে’,।
গত বুধবার বিকেলে স্কলার্সহোম’র শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাসের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমান আহমেদ দানিয়াল (১৯)-এর মরদেহ নিজ বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে এ ব্যাপারে অধিকতর তদন্ত চলছে বলে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
আজমানের মৃত্যুর পর ফেইসবুকভিত্তিক একটি সংবাদ মাধ্যমকে আজমানের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা আগের দিন গেছি। ভাইস প্রিন্সিপালে আমারে দূর দূর ছে ছে করছইন। কইছইন- তারে (আজমানকে) ঘুম পাতাইয়া থইতাম। সে কলেজে যায় না কেনে? কোন মা-বাপে কিতা ইচ্ছা করি স্কুল দেয় নানি? বাচ্চারে কিতা ঘুম পাতাইয়া রাখার লাগি স্কুলে দিছিনি?’
তিনি বলেন, ‘আমি গেছি একদিন, আমার হাজবেন্ড গেছইন একদিন। আরেকদিন আমরা একলগে গেছি। স্কলার্সহোম কোন সায় দেননি। ঠিক আছে, আমরা টিসি মানিয়া নিলাম। তারপরও তোমরা আমার পুয়ারে ইলা বেইজ্জত করলায় কেনে?’
আজমানের মা বলেন, ‘জানি আমার পুয়া দুর্বল। কিন্তু আমরা পুয়ারে বকা দেইনি। টিসি দেওয়ায় ক্লাসিক কলেজে গিয়া কালকে মাতিয়া আইছে’।
কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘আমার পুয়ায় কেনে ইতা করলো, কিতা কইছে তারা (স্কলার্সহোম)? কিতা কইছে? ঠিক আছে, আমার পুয়া পড়াত দুর্বল, কিন্তু তারা কেনো এতো বেইজ্জত করলো। আমার সামনে বেইজ্জত করলো’।
আজমানের মা আরও বলেন, ‘আমার পুয়া গেছেগি। আমি পড়ালেখার দরকার নাই। আমার ঘরে আমি কোন বই চাই না। সব বই নিয়া স্কলার্সহোমও ইটাইয়া ফালাও। আমার পুয়া ফিরত চাই। পড়ালেখা সবে ছাড়িদেও। পড়ালেখা আর দরকার নাই।’
তিনি স্কলার্সহোম কর্তৃপক্ষের প্রতি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘তোমরা দুর্বল বাইচ্চাইন লইয়া আলাদা মিটিং করলায় না কেনে? তারারে আলাদা লইয়া ক্লাস করলায় না কেনে?’
আজমান স্কলার্সহোমের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাসা নগরীর সুবিদবাজার বনকলাপাড়া এলাকায়। আজমান এইচএসসি’র প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় পাঁচ বিষয়ে ফেল করেছে বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়।
এদিকে, আজমানের মত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে স্কলার্সহোম কর্তৃপক্ষের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তার সহপাঠী ও ওই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। এমনকি অনেক সাবেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও স্কলার্সহোমের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাকেদের সাথে খারাপ আচরণ, পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক না থাকা, শিক্ষার্থী খারাপ করলে ছাড়পত্র দিয়ে বের করে দেওয়ার অভিযোগ তুলেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে আজমানের দাফন সম্পন্ন হয়।
তবে সব অভিযোগ ও আজমানের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাসের ভাইস প্রিন্সিপাল আশরাফুল ইসলামকে সিলেটের ডাক-এর পক্ষ থেকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। আমাদের রিপোর্টার তাকে এসএমএস দিলে তিনি উল্টো নম্বর ব্লক করে দেন।
তবে, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্য একটি সংবাদ মাধ্যমের সাথে আলাপকালে স্কলার্সহোম’র শাহী ঈদগাহ শাখার অধ্যক্ষ লে. কর্ণেল (অব.) মুনীর আহমেদ কাদেরী বলেন, সে একাদশ শ্রেণির দুটি পরীক্ষা ও দ্বাদশ শ্রেণিতে এইচএসসির প্রি-টেস্ট- সবগুলো পরীক্ষায়ই সাত বিষয়ের মধ্যে ৫টিতেই ফেল করে। এছাড়া সে ক্লাসেও খুবই অনিয়মিত।
তিনি বলেন, ৩/৪ দিন আগে আজমানের বাবাকে কলেজে ডেকে এনে এসব তথ্য জানানো হয়। এবং বলা হয়- এভাবে সে টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না। আপনি চাইলে তাকে অন্য কলেজে নিয়ে যেতে পারেন। অধ্যক্ষ বলেন, এরপর আজমান বা তার পরিবারের কেউ আর কলেজে আসেননি। তাদের সাথে আমাদের আর কোন কথাও হয়নি। গত বুধবার বিকেলে শুনি সে আত্মহত্যা করেছে। এটি খুবই দুঃখজনক। খবর পেয়ে আমরাও তার বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে শুনেছি, বুধবার সে নাকি বাবার সাথে অন্য একটা কলেজে গিয়েছিলো। ওই কলেজ থেকে আসার পর বাসার নিজের রুমে ঢুকে পড়ে। এরপর তার মরদেহ পাওয়া যায়।
প্রি-টেস্টে অকৃতকার্য হলে ছাড়পত্র প্রদান করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কাউকে ছাড়পত্র দেই না। সে এখতিয়ারও আমাদের নেই। এটি শিক্ষাবোর্ড অনুমোদন করে। তবে খারাপ ছাত্রদের অভিভাবকদের আমরা অনুরোধ করি- যেহেতু এখানে সে ভালো করতে পারছে না, তাই আপনারা চাইলে অন্য কলেজে নিয়ে যেতে পারেন।
এ ব্যাপারে আজমানের বাবা রাশেদ আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি।
শিক্ষার্থীদের যত অভিযোগ:
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ভাইস-প্রিন্সিপাল দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে হেয়-প্রতিপন্ন করে আসছেন। অপমান ও অপদস্থ করার ধারাবাহিক ঘটনাই আজমানের মৃত্যুর মূল কারণ বলে দাবি তাদের। তাদের অভিযোগ, পরপর একাধিক পরীক্ষার পর প্রি-টেস্টে ২১১ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলে সহযোগিতা করার পরিবর্তে তাদের অপমান করা হয়। এর জেরে আজমান নিজের স্কুল ইউনিফর্মেই আত্মহত্যা করে।
শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, বাংলা বিভাগের এক নারী শিক্ষক ক্লাসে এক ছাত্রীকে তার বাবার মৃত্যুকে নিয়ে কটূক্তি করেন। অন্যদিকে আইসিটি বিভাগের শিক্ষক প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেন, তিনি চাইলে পুরো ক্লাসকে ফেল করিয়ে দিতে পারেন। এমনকি তিনি অভিভাবকদের সঙ্গেও বিরূপ আচরণ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী জানান, “আমি নিজেও এ ধরনের অপমানের শিকার হয়েছি। একবার ভাইস-প্রিন্সিপালের রুমে বাবাকে নিয়ে গেলে, আমার বাবা হাত বাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানালেও তিনি পাশ ফিরে তাকে উপেক্ষা করেন। সেই অপমান এখনো আমাকে কষ্ট দেয়।”
শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, স্কলার্সহোমে অনেক ভালো শিক্ষক থাকলেও কর্তৃপক্ষ কিছু শিক্ষকের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে তাদের অপব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রিন্সিপালও সবসময় কিছু শিক্ষকের পরিবেষ্টনে থাকেন, যাদের শিক্ষার্থীরা “বডিগার্ড” বলে অভিহিত করেছেন।
আজমানের মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষার্থীরা বলছেন, এটি শুধু একজনের নয়। বরং সমগ্র শিক্ষার্থী সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা। তারা জবাবদিহি ও দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।