ছয় মাসেও মেলেনি মুক্তি
জকিগঞ্জে প্রভাবশালীর ৫ ফুট উচুঁ প্রাচীরে বন্দি চার শিক্ষার্থীসহ অসহায় পরিবার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮:০২:১১ অপরাহ্ন

জকিগঞ্জ (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা : সিলেটের জকিগঞ্জ পৌরসভার বিলেরবন্দ গ্রামের এক অসহায় পরিবার দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছেন। চার সন্তান, বৃদ্ধ অসুস্থ শাশুড়ী মা ও মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামীকে নিয়ে পরিবারটির কর্তা জেসিমন বেগম এখনো অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন একটি পাকা পাঁচফুট উচুঁ প্রাচীরের ভেতরে। তাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার একমাত্র রাস্তাটির প্রবেশমুখে দেয়াল নির্মাণ করে বন্ধ করে দিয়েছেন পাশের বাড়ির বিত্তশালী বাসিন্দা জকিগঞ্জ শহরের আজিজিয়া সেন্টারের মালিক এমাদ উদ্দিন ও তার ভাই এনাম আহমদ।
গত জুন মাসে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জকিগঞ্জ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে ঘটনাটি উত্থাপন করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুবুর রহমান জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় বহু গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে উপজেলা জুড়ে তখন ব্যাপক নিন্দার ঝড় ওঠে। কিন্তু তীব্র সমালোচনা ও প্রশাসনিক আশ্বাসের পরও আজ পর্যন্ত প্রায় পরিবারটি তাদের চলাচলের রাস্তা ফিরে পায়নি। উল্টো গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর প্রভাবশালীরা জিম্মি পরিবারের কাছে মানসম্মানের ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে। এতে পরিবারটির দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। এতে জকিগঞ্জের সাধারণ মানুষও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয়দের মতে, এই রাস্তাটি ছিল শত বছরের পুরনো চলাচলের পথ, যেটি দিয়ে গ্রামের বহু মানুষ চলতেন। জেসমিন আক্তারের পরিবারও এ পথ দিয়েই চলত প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কিন্তু এখন বিত্তশালীরা অসহায় পরিবারটির সঙ্গে যে ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করছে তা দুঃখজনক। প্রশাসনের উচিত দ্রæত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অবরুদ্ধ পরিবারকে চলাচলের রাস্তা দেওয়া।’’
জানা গেছে, প্রায় ৬ মাস থেকে জকিগঞ্জ শহরের আজিজিয়া সেন্টারের মালিক এমাদ উদ্দিন ও তার ভাই এনাম আহমদের নির্মিত দেয়ালের ভেতরে বন্দি আছেন একজন মানসিক রোগী, বৃদ্ধ নারী ও চার শিক্ষার্থী। এ নিয়ে ভুক্তভোগী জেসিমন বেগম গত ২৯ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছিলেন। কিন্তু ইউএনও সরেজমিন পরিদর্শন করেননি। পরে ১ জুলাই উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর ইউএনও মো. মাহবুবুর রহমান জকিগঞ্জ থানার ওসিকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন এবং প্রভাবশালী এমাদ উদ্দিন ও এনাম আহমদসহ উভয়পক্ষকে তাঁর অফিসে ডেকে আনেন এবং সমঝোতার উদ্যোগ নেন। তবে এই সমঝোতার দায়িত্ব দেওয়া হয় উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক দলের আহবায়ক ইকবাল আহমদ তাপাদারকে। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে একাধিক বৈঠক করলেও কোন সমাধান হয়নি।
বৈঠকে প্রভাবশালীরা নানা টালবাহানা করে এবং এক পর্যায়ে ইকবাল আহমদ তাপাদারের চাপাচাপিতে প্রভাবশালীরা অমানবিক ও অবান্তর শর্ত জুড়ে দেয় ‘তিনশ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি’ করে এক বছরের জন্য দেয়ালের এক ফুট ভেঙে চলাচলের সুযোগ দেবে, এক বছর পর আবার রাস্তা বন্ধ করে দেবে। এই অযৌক্তিক ও অনিশ্চিত শর্তে জেসিমনের পরিবার রাজি না হওয়ায় প্রভাবশালীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে তারা আর কোনওভাবেই জেসিমনের পরিবারকে রাস্তা দেবে না। পরে জেসিমন পুনরায় ইউএনও’র কাছে সহায়তা চাইলে ইউএনও আবারও বিষয়টি ইকবাল আহমদ তাপাদারের কাছে আপসে পাঠান। এরমধ্যে গড়িয়ে যায় প্রায় আড়াই মাস কিন্তু কোনভাবেই প্রভাবশালী এমাদ উদ্দিনরা দেয়াল অপসারণ করে রাস্তা দেয়নি। ফলে পরিবারটি গত ৬ মাস ধরে দেয়ালের ভেতরে পুরোপুরি অবরুদ্ধ ও অনেকটা সমাজচুত্য অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। অবরুদ্ধ ওই পরিবারের বড় মেয়ে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। দীর্ঘদিন ধরে প্রাচীর টপকে স্কুলে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় তার পরীক্ষা দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির আরেক সন্তান ইতোমধ্যে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া দুই সন্তানও পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার পথে। মসজিদ-মক্তবে যেতে পারছেনা। ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেয়াল টপকে সন্তানরা চলাচলের সময় একাধিকবার গুরুত্বর আহত হয়েছে।
ভুক্তভোগী জেসিমন বলেন, ‘আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ে দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে পারছে না, এক ছেলে ইতোমধ্যেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার রাস্তা নেই। এমনকি কেউ মারা গেলেও খাটিয়া কিভাবে কবরস্থানে নিয়ে যাবো জানি না। আমার সন্তানরা মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ৩শ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি করে এক বছরের জন্য অনিশ্চিত অমানবিক শর্তে এক ফুট দেয়াল ভেঙ্গে রাস্তা দিবে প্রভাবশালীরা। এক বছর পর আবারও বন্ধ করে দেবে! তাহলে আমার স্থায়ী সমাধান হলো কোথায়?’
তিনি অভিযোগ করেন, “গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর প্রভাবশালীরা আমাদের ওপর মানসিক নির্যাতন আরও বাড়িয়েছে। তারা নিয়মিত কটূক্তি ও গালাগাল করে। বারবার আমার অসুস্থ স্বামী প্রভাবশালীদের বাড়িতে গিয়ে রাস্তা খুলে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করেছেন চলাচলের রাস্তা দেওয়ার জন্য কিন্তু তারা অপমানিত লাঞ্চিত করে তাড়িয়ে দেয়। প্রভাবশালীদের চাচা মানিক মিয়াও রাস্তা দেওয়ার আশ্বাস দেন কিন্তু পরে বিষয়টি রাস্তা না দিয়েই অপরাগতা স্বীকার করে সরে যান।
তিনি অভিযোগ করেন, বাড়ির জায়গার ওপর লোভ পড়ায় প্রভাবশালীরা এতো অমানবিক আচরণ করছে। যাতে আমরা রাস্তা না পেয়ে বাড়িঘর ফেলে চলে যাই।”
আজিজিয়া সেন্টারের মালিক এমাদ উদ্দিনের চাচা মানিক মিয়ার সঙ্গে কথা বললে তিনি স্বীকার করেন, “একসময় এই রাস্তাটি দিয়ে লিটন আহমদের পরিবার চলাচল করত। পরিবারটি বর্তমানে অবরুদ্ধ অবস্থায় অত্যন্ত অসহায় আছে।” তবে তিনি জানিয়ে দেন, তার ভাতিজারা (এমাদ ও এনাম) এই পরিবারকে রাস্তা দেবে না। বিষয়টি প্রশাসন দেখুক তাতে সমস্যা নেই।”
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা নোমান উদ্দিন বলেন, ‘একটি অসহায় পরিবারকে টাকার জোরে বন্দি করে রাখা হয়েছে, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। প্রশাসনের খামখেয়ালিতে পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে পরিবারটিকে জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করে চলাচলের রাস্তা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সিলেট বিভাগীয় সভাপতি রাকিব আল মাহমুদ বলেন, ‘একটি পরিবারকে সমাজচুত্য ও অবরুদ্ধ করে রাখা মানে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দন্ডনীয় অপরাধ। প্রশাসনের উচিত দ্রæত পরিবারটিকে এই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনা ধামাচাপা দিতে দিতে প্রভাবশালীরা পরিকল্পিতভাবে ৬ মাস ধরে বিভিন্ন কৌশলে সময়ক্ষেপণ করেছে। এমনকি এমাদ উদ্দিনের চাচা মানিক মিয়াও প্রথমদিকে সমাধানের আশ্বাস দেন। কিছুদিন পরে আবার ভাতিজাদের সুওে তিনিও কথা বলেন এবং বিষয়টি এড়িয়ে যান।
জেসমিন আক্তারের স্বামী ইয়াসমিন আহমদ লিটন আক্ষেপ করে বলেন, ‘চার সন্তানের চোখে স্বপ্ন, স্কুলব্যাগ, খাতা সবই আছে। নেই শুধু মুক্ত চলার পথ। স্কুল থেকে ফোন আসে কেন সন্তানরা ক্লাসে যাচ্ছে না। আমি কী বলব? দেয়াল টপকে যেতে ভয় পাচ্ছে?’
জানতে চাইলে জকিগঞ্জ শহরের আজিজিয়া সেন্টারের মালিক এমাদ উদ্দিন বলেন, ‘আমার রাস্তার পাশে আমি দেয়াল দিয়ে নিরাপদ করেছি, অন্য কারো জায়গায় দেইনি। এতে জেসমিন আক্তারের পরিবার অবরুদ্ধ হলেও আমার করার কিছু নেই। তবে তিনি স্বীকার করেন আগে এ রাস্তা দিয়ে জেসমিনের পরিবারের লোকজন চলাচল করেছেন।’
উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য সাংবাদিক কেএম মামুন বলেন,‘আমরা আইন-শৃঙ্খলা সভায় বিষয়টি উত্থাপন করলে ইউএনও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ দেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে পরিবারটি প্রায় ৬ মাস ধরে এখনো দেয়ালের ভেতর অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, একটি অসহায় পরিবারকে দেয়ালঘেরা বন্দিদশা থেকে উদ্ধারে প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, চার শিশুর শিক্ষাজীবন ধ্বংসের পাশাপাশি মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।’
জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম মুন্না জানান, ‘পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সত্যতার বিষয়টি জানিয়েছে। যেহেতু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তাই তিনি বিষয়টির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।’
জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও কৃষকদলের জেলা আহবায়ক ইকবাল আহমদ তাপাদার জানান, ‘তিনি আপসে সমাধানের চেষ্ঠা করেছেন। এমাদ উদ্দিনরা শর্ত সাপেক্ষে স্ট্যাম্প করে এক বছরের জন্য জেসমিন বেগমের পরিবারকে সামান্য দেয়াল ভেঙ্গে রাস্তা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু এক বছরের শর্তে স্ট্যাম্প করে জেসমিনের পরিবার রাস্তা নিতে রাজী হয়নি। তাই বিষয়টি সমাধান হয়নি। তিনি বলেন, জেসমিনের পরিবারের রাস্তা আরেকটা পক্ষও দখল করেছে দখলকৃত সেই রাস্তা উদ্ধার হয়ে গেলে তারা চলাচল করতে পারতো। এমাদ উদ্দিনরা তাদের নিরাপত্তার জন্য দেয়াল দিয়েছে বলে জানিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুবুর রহমান জানান, ‘ঘটনাটি সমাধানের জন্য স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিষয়টি যদি এখনো সমাধান না হয় তাহলে আবারও ডাকাবো।’