বাড়ছে জীবনের ঝুঁকি, বৈধতা নেই বিস্ফোরক অধিদপ্তরের
নগরীর ফুটপাত-রাস্তায় অরক্ষিত অবস্থায় সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ২:৫৯:১১ অপরাহ্ন

আহমাদ সেলিম :
সিলেট নগরীর ভেতর সড়কের মোড়ে, ফুটপাতের দোকানগুলোতে থাকা ‘ভয়ংকর এক দানবে’র নাম এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার। এগুলো নিয়ন্ত্রণে পরিলক্ষিত হচ্ছে না কার্যকর কোন উদ্যোগ। অরক্ষিত অবস্থায় থাকা এ সকল গ্যাস সিলিন্ডার থেকে বড় ধরণের দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়িয়ে দেয়া যায় না। বিস্ফোরক অধিদপ্তর বলছে, এভাবে সিলিন্ডার ব্যবহার সম্পূর্ণ অবৈধ। সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের কোনো অনুমতি তাদের দেয়া হয়নি।’
নগরীর ভেতর জনসমাগম হয়-এমন সব সড়কের মোড়ে, অস্থায়ী চায়ের দোকান কিংবা ফাস্টফুডের কি পরিমাণ দোকান হবে তার হিসেব কারো কাছে নেই। বন্দরবাজার, রিকাবীবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা, ওসমানী হাসপাতাল সড়ক, মদিনামার্কেট, শাহী ঈদগাহ-সবখানেই সেই দোকান রয়েছে। ফাস্টফুডের সেই দোকানগুলোতে চা, চটপটি, ফুচকা থেকে শুরু করে খিচুড়িও বিক্রি হচ্ছে। এই দোকানগুলো সবচেয়ে বেশী কোথায়, এমন প্রশ্নের জবাবে যে কেউ বলবে, রিকাবীবাজার পয়েন্ট থেকে পুরো স্টেডিয়ামের সীমানাজুড়ে। যেখানে অন্তত ৭০টির অধিক অস্থায়ী দোকানের সারি রয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ডাক্তারপাড়া নামে পরিচিত সেই জায়গায় মানুষের জটলা লেগেই থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী, তাদের স্বজন, বিভিন্ন কোম্পানীর ফার্মাসিস্ট, পথচারি, সংস্কৃতিকর্মী এই দোকানগুলোর নিয়মিত কাস্টমার। আর কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে কোনো অনুষ্ঠান হলে তো কথাই নেই।
গতকাল সন্ধ্যার পর সরেজমিন দেখা যায়, রিকাবীবাজার কবি নজরুল অডিটোরিয়ামের পাশে মানুষের জটলা। কেউ কেউ দলবদ্ধ দাঁড়িয়ে চা ছোলা, পিয়াজু খাচ্ছেন। কারো গরম চায়ের পেয়ালা থেকে উড়ছে ধোঁয়া। দোকানগুলো থেকে ক্রেতাদের এক কিংবা দুই হাতের দূরত্ব। সব দোকানেই জ্বলছে চুলার আগুন। পাশাপাশি রাখা গ্যাস ভর্তি বড় বড় সিলিন্ডার। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ দোকানে দেখা যায় এমন চিত্র। চুলার নিচে কিংবা এক দেড় ফুট দূরত্বে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে চলছে রান্না। জায়গা কম হওয়ায় অনেকে সরাসরি দোকানের সাথেই বেঁধে রেখেছেন সিলিন্ডারগুলো।
আলাপ করে জানা গেছে, ব্যবসা ভালো হওয়ায় অনেকে দুইটি করে সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। অনেকে সিলিন্ডিারের পাশে দাঁড়িয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন। অথচ চুলা থেকে অন্তত তিন থেকে চার ফুট দূরে রাখার নিয়ম রয়েছে গ্যাসের সিলিন্ডার। এছাড়া চুলা, সিলিন্ডার থেকে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি ওপরে রাখতে হবে। সিলিন্ডারটি লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন থেকে চার ফুট দূরে স্থাপন করতে হবে।
সিলিন্ডার রান্নাঘরের চুলার নিচে, ক্যাবিনেটের ভেতরে রাখা যাবে না। বরং খোলামেলা জায়গা এবং সমান ভূমিতে রাখতে হবে, যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে। সিলিন্ডারের আশপাশে আগুন জ্বালানো এবং ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অথচ এসবের কিছুই মানা হচ্ছে না।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করছেন, তারা নিজেরাও সচেতন নন সেইসব ঝুঁকি সম্পর্কে। আর এর কারণেই দিন দিন দোকানের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অথচ একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সবার আগে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বিক্রেতা নিজেই। কারণ প্রতিটি সিলিন্ডারই দোকানের সাথে বাধা অথবা বিক্রেতার পায়ের পাশে রাখা অবস্থায় দেখা গেছে।
নজরুল, সুহেল মিয়া, লায়েক, রুবেল সহ বেশ কয়েকজন দোকানির সাথে কথা হয় সিলিন্ডারের ভয়াবহতা নিয়ে, বিকল্প কিছু ব্যবহার করা যায় কি-না সে বিষয়ে। তারা বলছেন, ‘আমরা তো অনেকদিন ধরেই এভাবে ব্যবসা করছি। এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা তো ঘটলো না।’
নগরীর ভেতর বিভিন্ন ফুটপাত ও রাস্তার পার্শে¦ টি-স্টল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন অস্থায়ী দোকানে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার বন্ধে সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছে যৌথভাবে স্মারকলিপি দিয়েছে সিলেট কল্যাণ সংস্থা (সিকস), সিলেট বিভাগ যুব কল্যাণ সংস্থা ও সিলেট প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা।
গত মঙ্গলবার এই স্মারকলিপি দেয়া হয়। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ফুটপাত ও রাস্তায় যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ফলে জনসাধারণ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। অথচ একেকটি সিলিন্ডার একেকটি বোমার মতো। অনেক জায়গায় মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় এ সকল সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তাই অনতিবিলম্বে এ সকল অরক্ষিত ও মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সংস্থার সভাপতি এহসানুল হক তাহের বলেন, সিলেটের সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকা জল্লারপারে বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারের নিচে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে দায়সারাভাবে চলছে টি স্টলের কার্যক্রম। এর পাশেই ফুটপাতে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে চলছে হোটেল ব্যবসা।’
স্টেডিয়ামের পাশেই রয়েছে রিকাবীবাজার, কয়েক গজ দূরে পুলিশ লাইন। তাই সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত এই দোকানগুলোতে মানুষের আনাগোনা থাকে। পাশে স্টেডিয়াম তো আছেই। সিলেট স্টেডিয়ামের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, স্টেডিয়াম মার্কেটে অসংখ্য ডাক্তারের চেম্বার। বিপুল সংখ্যক রোগী প্রতিদিন এখানে আসা-যাওয়া করে। আছে শতাধিক ওষুধের দোকান। যেকোনো সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্টেডিয়াম মার্কেটের দুজন চিকিৎসক বলেন, ‘সন্ধ্যার পর থেকে এই দোকানগুলোতে মানুষের ব্যাপক সমাগম হয়। পরিস্থিতির বাস্তবতা বলছে, কখনো যদি বিস্ফোরণ ঘটে; তাহলে হতাহতের সংখ্যাও বেশী হবে। এখনি উচিত, প্রশাসনের দৃষ্টি দেয়া।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা যায়, চুলা থেকে অন্তত দশ ফুট দূরে রাখতে হবে গ্যাসের সিলিন্ডার। গ্যাস সিলিন্ডার চুলা থেকে এবং রোদ থেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ এটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার মধ্যে রাখা জরুরি। এছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার কাত করে রাখা যাবে না। আবার সিলিন্ডার যে জায়গায় রাখা হবে সেখানে ভেন্টিলেশন থাকতে হবে। কারণ সিলিন্ডারের এলপিজি অনেক ভারী। এটি নিচের দিকে ট্রাপ হয়। এখানে যদি উপরের দিকে ভেন্টিলেশন রাখা হয় ; তবে তা কাজ করবে না। এছাড়া সব গ্যাস সিলিন্ডার চার বছর পর পর হাইড্রো টেস্টিং করা জরুরি। এলপিজি গ্যাস রিফিল করা হয় ‘টেন বার’ প্রেসারে। হাইড্রো টেস্ট করে দেখতে হবে সিলিন্ডারটি আসলে উপযোগী কিনা। অথচ যারা ফুটপাতে ব্যবসা করছে তারা এসবের কিছুই জানেন না।
সিলেটের ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এর সহকারি পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, ‘সিলিন্ডার থেকে চুলার দূরত্ব তিন থেকে চার ফুট দূরে রাখতে হবে। চুলার হিট যেন সিলিন্ডারে না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরী। অতিরিক্ত তাপ বহন করতে পারবে না সিলিন্ডার। আর তখনি বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে। ফুটপাতে তো আরো বেশী ঝুঁকি।’
এ প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. সারওয়ার আলম বলেন, আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তর সিলেটের সহকারি বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. মোস্তফা ফারুক বলেন, ‘এদের কোনো বৈধতা নেই। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ব্যবহার করছে। আমরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাথে বসবো। তারপর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’