বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপের গল্পকথা- রোমেনা রোজী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ৫:১২:৩৫ অপরাহ্ন

‘আমায় তুমি এনে দিও বৃষ্টি ভেজা লাল কাঠগোলাপ’। লাল কাঠগোলাপ, গুইচি চাঁপা বা লাল গুলাচি (দ্বিপদ নাম: Plumeria rubra) হচ্ছে পত্রপতনশীল প্রজাতির Plumeria গণের একটি উদ্ভিদ। মূলত মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, কলম্বিয়া এবং ভেনিজুয়েলা অঞ্চলের স্থানীয় এ উদ্ভিদটি বিশ্বজুড়ে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় এবং এটি বাগান ও পার্কের একটি জনপ্রিয় উদ্ভিদ।
‘কাঠগোলাপ’ নামটা শুনলে মনে হয় কাঠ দিয়ে তৈরি রুক্ষতায় ভরা গোলাপ ফুল। আর ‘গোলাপ’ নামটি মনে পড়লেই চোখে ভাসে কাঁটাযুক্ত গাছে রক্তিমআমায় ভালোবাসায় সিক্ত পাপড়িগুচ্ছ। কিন্তু লাল পাপড়ি ও কাঁটা ছাড়াও সুবিশাল উঁচু গাছেও ধরে গোলাপ, কাঁটাবিহীন লাল পাপড়ির লাল কাঠগোলাপ। কাঠগোলাপ বাংলার প্রকৃতিতে এক নরম, স্নিগ্ধ উপস্থিতি। এই ফুল শুধু চোখের আরাম নয়, বরং একটি আবেগ, স্মৃতি, এবং নৈঃশব্দ্যের প্রতীক। কাঠগোলাপ তার মাধুর্য, ঘ্রাণ এবং ঝরেপড়া সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে মন ছুঁয়ে যায়। লাল কাঠগোলাপের স্নিগ্ধতা, ভালোবাসার এক নতুন সংজ্ঞায়িত করে। প্রকৃতির এই লাল উপহার, মনকে জুড়িয়ে দেয় এর সৌরভে। লাল কাঠগোলাপ, যা ভালোবাসার প্রতীক এবং প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি।
গোলাপের সঙ্গে ফুলটির কোনো সম্পর্ক নেই। তাও অধিকাংশ লোক ফুলটিকে কাঠগোলাপ নামেই চেনে। তবে যতদূর জানা গেছে ফুলটি করবী বংশোদ্ভূত। নাম কাঠকরবী। লোকের মুখে মুখে ফুলটি কাঠগোলাপ নামে পরিচিতি পেয়েছে। কাঠকরবী বললে কেউ চেনে না।
কাঠগোলাপ গাছে সারা বছর ফুল ফোটে। তবে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকালে গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। অঞ্চলভেদে এ ফুল কাঠচাঁপা, গরুড়চাঁপা, গুলাচ, গুলাচিচাঁপা, গোলাইচ, গোলকচাপা, চালতাগোলাপ ইত্যাদি নামে পরিচিত। দেখতে দুধের মতো সাদা, কোনোটি সাদা পাপড়ির ওপর হলুদ দাগ, আবার কোনোটি লালচে গোলাপি রঙের।
লাল কাঠগোলাপ , কার্ল লিনিয়াস বর্ণিত প্রথম উদ্ভিদসমূহের মধ্যে অন্যতম, এবং স্পীশীজ প্লান্টারাম -এর ১৭৫৩ সংস্করণেও এর নাম পাওয়া যায়।এর গণ নাম লাতিন রুবার “লাল” থেকে উদ্ভূত।এছাড়া অ্যাকুমিনটা, অ্যাকিউটিফোলিয়া এবং লুটিয়া ইত্যাদি নাম বিশেষণ দেখা যায়, তবে সেগুলো অকার্যকর। এর সাধারণ নামগুলির মধ্যে রয়েছে কাঠগোলাপ (ফ্রেঞ্জিপাণি) ,লাল চাঁপা (পাউসিপান) , লাল-জুঁই, লাল কাঠগোলাপ (ফ্রেঞ্জিপানি) , সাধারণ কাঠগোলাপ (ফ্রেঞ্জিপানি) , মন্দিরের গাছ, বা কেবল কাঠচাঁপা (প্লামেরিয়া) ।
“frangipani” (কাঠগোলাপ) সাধারণ নামটি ইতালীয় উন্নত গোত্র থেকে উদ্ভূত একটি ষোড়শ শতাব্দীর মার্কাস, যার থেকে কাঠ-গোলাপের সুগন্ধি আবিষ্কৃত হয়। গণ নামটি চার্লস প্লামিয়ার, একজন ফ্রান্সিসকান ক্রমের ফরাসী সন্ন্যাসী এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানী, -এর সম্মানে গৃহীত।
মেক্সিকোতে সাধারণ নাম হলো ক্যাকালোক্সচিটোল বা ক্যাকালোক্সুচিটোল, নামটি এসেছে নহুয়াতল থেকে এবং এর অর্থ “কাকের ফুল”। ১৯৭১ সালে নিকারাগুয়ার জাতীয় ফুল হিসাবে লাল কাঠগোলাপকে ঘোষণা করা হয়, যেখানে এটি সাকানজোচে নামে পরিচিত। স্পেনিশ ভাষায় কাঠগোলাপকে আলহেলি, আলহেলি সিমারন এবং সুচে নামেও উল্লেখ করা হয়। মেলিয়া পরিভাষাটি একটি হাওয়াইয়ান শব্দ। কুক দ্বীপপুঞ্জগুলিতে এটি টিপানী নামে সুপরিচিত। এটি ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপকভাবে জন্মে, যেখানে এর নাম চম্পা বা এর থেকে উদ্ভূত যেমন চাঁপা, চাম্পিজ ইত্যাদি। এটিকে পাকিস্তানেও চম্পা বলা হয়। কম্বোডিয়ায় এর নাম চাম্প্পি ক্রাহা: ম ( ক্রোম নামেও লিখিত, যার অর্থ ‘লাল’) বা চাম্পি স্লাক শ্রুয়েচ , অন্যদিকে প্রজাতির জন্য ফরাসি পরিভাষা হলো ফ্রেঞ্জিপানিয়ের আ ফ্লুয়ারস রৌজেস । শ্রীলঙ্কায় সিংহলিতে এটিকে আরালিয়া বলা হয়। এটি ব্রাজিলেও নানা নামে পরিচিত, যেমন জস্মিম-দে-কায়েনা, জেসমিন-দো-পারা এবং জেসমিন-মাঙ্গা। পর্তুগিজ ভাষায় এর আরেকটি নাম পাওয়া যায় ফ্লোর-দে-সান্তো-আন্তোনিও। মায়ানমারে এটিকে মওক-সাম-কা, মওক-সাম-পাইলং এবং সোনপাবাটায়িং নামে ডাকা হয়। চিনে এটির সাধারণ নাম জি দান হুয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে নোসগে।
Plumeria rubra ডগবেইন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি একটি ছড়িয়ে পড়া গুল্ম বা ছোট উদ্ভিদ হিসাবে ২-৮ মি, (৫-৬ ফুট) উচ্চতার এবং অনুরূপ প্রস্থে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এর একটি সরু সরস গুঁড়ি ও পাতলা ধূসর ছাল দিয়ে আচ্ছাদিত সসেজ-রূপ ভোঁতা আরও কিছু শাখা থাকে। শাখাগুলি কিছুটা ভঙ্গুর এবং ভাঙ্গলে, একটি সাদা কষ বের হয় যা ত্বকে ও শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। গাছের কাণ্ডে পাওয়া এই কষ প্রকৃতপক্ষে বিষাক্ত, তবে বিপুল পরিমাণে না হলে মারাত্মক নয়। বড় সবুজ পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেমি (১২ থেকে ২০ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা ও পর্যায়ক্রমে সাজানো এবং শাখাগুলির শেষে গুচ্ছাকারে থাকতে পারে। বনে এ গাছের গুঁড়ি ২৫ সে,মি, পর্যন্ত হতে পারে। যদিও চাষে এর দৈর্ঘ্য হ্রাস পেতে থাকে।
এগুলি পত্রঝরা, বছরের শীতকালীন মাসগুলিতে পাতা পড়ে যায়। ফুলগুলি প্রান্তীয়, গ্রীষ্মে শাখাগুলির শেষ প্রান্তে দেখা যায়। প্রায়শই প্রচুর এবং খুব স্পষ্ট, বেশ সুগন্ধযুক্ত এবং পাঁচটি পাপড়ি থাকে। ফুলগুলি সকালে এবং সন্ধ্যায় তাদের সুগন্ধ ছড়ায়। এই সুগন্ধ গোলাপ, সাইট্রাস (লেবুবর্গ) এবং দারুচিনির অনুরূপ। ফুলের কেন্দ্রে রঙ, সাধারণ গোলাপী থেকে হলুদের ছায়াযুক্ত সাদা পর্যন্ত হয়ে থাকে। খোলার আগে প্রাথমিকভাবে নলাকার ফুলগুলি ৫–৭.৫ সেমি (২–৩ ইঞ্চি) ব্যাসের হয় এবং খুবই কম বীজ উত্পাদনে অংশ নেয়- ২০-৬০ টি দলযুক্ত বীজ, ১৭.৫ সেমি (৭ ইঞ্চি) -এর কোষ ধারণ করে। ফলগুলি নলাকার কোষ যা চাষে খুব কমই দেখা যায়।
কাঠগোলাপ মূলত প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের ফুল। এটি মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল, ভেনিজুয়েলা ও দক্ষিণ ভারত হয়ে এ দেশে থিতু হয়েছে। এই উদ্ভিদটির রয়েছে অসংখ্য প্রজাতি। যদিও আমাদের দেশে গুটিকয়েক ভ্যারাইটি যেমন- পস্নুমেরিয়া রুব্রা, পস্নুমেরিয়া অ্যালবা, পস্নুমেরিয়া অবটুজা ও পস্নুমেরিয়া পুডিকাই বেশি দেখা যায়। প্রজাতিভেদে গাছের উচ্চতা ৮/১০ ফুট হতে পারে। গাছের পাতার গড়নও বিচিত্র ধরনের। পস্নুমেরিয়া রুব্রার পাতার কিনারা সুচালো, পস্নুমেরিয়া অবটুজার পাতা গোলাকার ও পস্নুমেরিয়া পুডিকার পাতা চামচ আকৃতির। অনেকের মতে, পস্নুমেরিয়া রুব্রা ও পস্নুমেরিয়া অবটুজার সংকরায়নের মাধ্যমে প্রথম হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করা হয়।
কাঠগোলাপ গাছের উপকারিতাও রয়েছে :
এর ফুল ও কাণ্ড জ্বর, রক্ত আমাশয়, হুপিং কাশিইত্যাদির নিরাময়ের ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষধ তৈরিতেও কাজে লাগে। P. rubra ফ্লাভোপ্লুমিয়েরিন, একটি অ্যান্টিবায়োটিক যা যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে । এছাড়াও উদ্ভিদটিকে ছত্রাকনাশক, ভাইরাস-প্রতিরোধী, বেদনানাশক, খিঁচুনি-রোধক এবং হাইপোগ্লাইসেমিক হিসাবে দেখানো হয় ।
কাঠগোলাপ ফুল গ্রীষ্মকাল (মার্চ-জুন) এবং বর্ষাকালে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ফোটে, তবে সাধারণত এই ফুল সারা বছর ধরেই গাছে দেখা যায়। গাছের জন্য প্রয়োজনীয় দিনের আলো এবং ভালো পরিবেশ পেলে এই ফুল ফোটে, তাই শীতকালে গাছের নতুন পাতা গজানো শুরু হলে ফুল আসার সম্ভাবনা বাড়ে।