সিলেটে দুর্যোগ-ঝুঁকি, রেডক্রিসেন্ট ও ‘রিজিওনাল রেসপন্স হাব’
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ৮:০৬:৫০ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম :
সম্প্রতি বাংলাদেশে পরপর কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় সারাদেশে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত ভূমিকম্প- অতিসংবেদনশীল সিলেট অঞ্চলে আতঙ্ক আরও তীব্র হয়েছে। কারণ এই এলাকায় বহু বছর ধরে ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিণের ভারতীয় প্লেট ও উত্তরের বার্মিজ প্লেটের মাঝ বরাবর অবস্থিত হওয়ায় পুরো দেশই ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সিলেট অঞ্চল সরাসরি ডাউকি ফল্ট (Dauki Fault) এর ওপর অবস্থান করায় এখানে ঝুঁকি দ্বিগুণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডাউকি ফল্ট দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী ও সক্রিয় ভূকম্পন উৎপাদক ফাটল। সিলেটে বারবার মৃদু কম্পন, ভূগর্ভস্থ নড়াচড়ার বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদে চাপ সঞ্চয় ইঙ্গিত দেয় ‘এলাকাটি একটি বড় ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পূর্বসংকেতের মধ্যেই রয়েছে’। সাম্প্রতিক ভূমিকম্প আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে : ভূমিকম্পের কোনো পূর্বসতর্কতা নেই, দুর্যোগ কয়েক সেকেন্ডে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে, এবং প্রস্তুতি ছাড়া প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দেশের সবচেয়ে দ্রুত, নির্ভরযোগ্য ও প্রশিক্ষিত মানবিক সংস্থা হিসেবে দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়ার প্রথম সারিতে কাজ করছে, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে, যেখানে ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি দেশের সর্বোচ্চ।
Sylhet Regional Humanitarian Response Hub: একটি কৌশলগত পরিকল্পনা : সিলেটের দুর্যোগ ঝুঁকি বিবেচনায় রেড ক্রিসেন্ট একটি আধুনিক ও সমন্বিত ‘রিজিওনাল ডিজাস্টার/ হিউম্যানিটারিয়ান রেসপন্স হাব’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই হাব প্রতিষ্ঠিত হলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ বৃহত্তর এলাকায় যেকোনো বড় দুর্যোগে দ্রুত, দক্ষ ও সমন্বিত মানবিক প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবিত হাবে থাকবে : জরুরি কন্ট্রোল রুম, রেসকিউ ও লজিস্টিক সরঞ্জাম সংরক্ষণাগার, ফার্স্ট এড ও ট্রায়াজ স্টেশন, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পয়েন্ট, স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ একাডেমি, রক্তকেন্দ্রের দ্রুত প্রতিক্রিয়া ইউনিট, খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জরুরি রিজার্ভ স্টক।
Sylhet Emergency Health & Medical Capacity Strengthening :
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা আরও শক্তিশালী করার জন্য রেড ক্রিসেন্ট ইতোমধ্যে : মাতৃমঙ্গল হাসপাতালে নতুন প্যাথলজি ল্যাব স্থাপন, নতুন অ্যাম্বুলেন্স সংযোজন, নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বাস প্রদান, মুজিব জাহান রক্তকেন্দ্রে কোটি টাকার ঋজঝঝ মেশিন এবং আধুনিক সেন্ট্রিফিউজ স্থাপন, এসব গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সম্পন্ন করেছে। এই উদ্যোগগুলো ভূমিকম্প, বন্যা বা যেকোনো দুর্যোগের সময়ে দ্রুত চিকিৎসা প্রদান, রক্তসেবা এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করবে।
Sylhet On-Ground Response Forces: সর্বদা প্রস্তুত মানবিক শক্তি
রেড ক্রিসেন্ট সিলেট অঞ্চলে সর্বদা প্রস্তুত রাখে : UDRT (Unit Disaster Response Team – স্থানীয় পর্যায়ে তাৎক্ষণিক উদ্ধার ও ফার্স্ট এইড, প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক, প্রথমিক চিকিৎসা টিম, মোবাইল মেডিকেল ইউনিট, লাইট সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম; ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার, ইভাকুয়েশন ও নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর। কারণ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের একটি তীব্র কম্পন সিলেটের ঘনবসতিপূর্ণ শহর, টিলা অঞ্চল এবং চা-বাগান এলাকায় ভয়াবহ মানবিক ক্ষতি করতে পারে।
Community Preparedness & Ongoing Activities in Sylhet রেড ক্রিসেন্ট সিলেটে নিয়মিত পরিচালনা করছে :
ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা মহড়া, লাইট সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি ভিত্তিক ইভাকুয়েশন পরিকল্পনা, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রশিক্ষণ, স্কুল-কলেজ-বাজারে দুর্যোগ প্রস্তুতি শিক্ষা, মাতৃমঙ্গল হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা সক্ষমতা বৃদ্ধি, রক্তকেন্দ্রে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন, এসব কার্যক্রম সিলেটের মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে এবং একটি সুসংগঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভিত্তি তৈরি করছে।
Toward a Disaster-Resilient Sylhet : রেড ক্রিসেন্টের মানবিক অঙ্গীকার :
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সিলেট অঞ্চলে দুর্যোগ-সহনশীলতা বাড়াতে- মানবিক প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, উদ্ধার সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ, চিকিৎসাসেবা উন্নয়ন, আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজন, ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ভূমিকম্প, পাহাড়ি ঢল, আকস্মিক বন্যা, অগ্নিকাণ্ড ও নগর দুর্যোগ- সব ক্ষেত্রেই রেড ক্রিসেন্টের ধারাবাহিক উদ্যোগ সিলেটকে ধীরে ধীরে একটি “দুর্যোগ-সহনশীল মানবিক অঞ্চল” হিসেবে গড়ে তুলছে।
ঢাকার সাম্প্রতিক ভূমিকম্প আমাদের কঠিন সত্য দেখিয়ে দিয়েছে- একটি বড় ভূমিকম্প কখন, কোথায় ও কত মাত্রায় আঘাত করবে তা কেউ জানে না। তাই এখনই প্রয়োজন : দুর্যোগের পূর্ণ প্রস্তুতি, দ্রুত প্রতিক্রিয়া সক্ষমতা, দক্ষ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি।
বিপদের মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, জীবন রক্ষা করা এবং সঠিক মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করাই বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মানবিক দায়িত্ব, কর্তব্য ও অঙ্গীকার।
লেখক : সাবেক ট্রেজারার, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জাতীয় সদর দপ্তর (ঢাকা)। সাবেক সেক্রেটারি রেড ক্রিসেন্ট সিলেট ইউনিট (এডহক)।



