সিলেটে দুদকের গণশুনানী যেমন দেখেছি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০৪:৪৮ অপরাহ্ন
আশফাকুজ্জামান চৌধুরী :
দুর্নীতি বাংলাদেশের মূল সমস্যাসমূহের একটি। দুর্নীতির অপরাধের সাথে জড়িত নন, এমন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা আইন অনুসারে পাবলিক সার্ভেন্ট গণ্য হন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা বর্তমানে নগণ্য বলা চলে। তবে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত রাখা সৎ কর্মকর্তাদের সম্মান জানাতে ব্যতিক্রম এর পূর্বঘোষণা প্রয়োজন। মেহেরবানী করে সৎ কর্মকর্তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের ঐ তালিকার অংশ ধরে নেবেন।
দেশে সাধারণ মানুষ দারুণভাবে দুর্নীতির শিকার হলেও দুর্নীতিবাজরা বরাবরই থাকেন ধরা ছোয়ার বাইরে। বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের প্রাপ্ত বেতনের সাথে তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিলাসী জীবনযাপনের সাজয্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একজনের দুর্নীতির চেরাগে পরিবারের অন্য সদস্যরা দেশে বিদেশে সম্পদে ফুলে ফেঁপে ওঠেন। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই লুটপাটের টাকায় তারা বেগমপাড়া গড়ে তুলেছেন।
দুর্ভাগা দুর্নীতিবাজ ব্যাক্তিদের কেউ কেউ দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হলেও বিচার শেষে মামলার নিষ্পত্তিতে অধিকাংশ অভিযুক্ত ব্যাক্তিরা খালাস পান বা কিংবা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা তাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়া হতে প্রাকৃতিকভাবে নিস্তার দেয়। দুদকের নিজস্ব পরিসংখ্যানেই এই তথ্য উদঘাটিত হয় যে, মামলা প্রমাণে দুদক ব্যার্থ। মূলত দুদকের দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদন বা মামলা প্রমাণে অনীহাই অভিযুক্ত আসামীর খালাস প্রাপ্তির মাধ্যমে দুর্নীতির মামলার যবানিকাপাত ঘটে।
তাছাড়া, দুদকের গত প্রায় দুই দশকের দুর্নীতির অভিযোগের চর্চায়, অনুসন্ধানকালেই দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দেয়ার বিশেষ দুর্নাম রয়েছে। দুদকের প্রশ্নবিদ্ধ অনুসন্ধান পরিসমাপ্তি বিষয়টি আদালতের নজরে আসলে ২০২৩ সালে মহামান্য হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ অনুসন্ধান পরিসমাপ্তির চার শতাধিক নথি তলব করেন। এ বিষয়ে এনবিআর এর মতিউর রহমানই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুদক মতিকে চারবার দায়মুক্তির সার্টিফিকেট দিলেও, শেষমেষ লাখ টাকার ছাগল ই তার দুর্নীতির চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। সার্টিফিকেট দাতা দুদকের সেসকল মহান কর্মকর্তাগণ এখনো দুদকে কর্মরত হলে, আমাদের বলার কিছু না থাকলেও, বোঝার আছে।
গত ২৩ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে সিলেটে দুদকের গণশুনানী অনুষ্ঠিত হয়। দুর্নীতি বিষয়ক আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন এর কার্যক্রম ও দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক কার্যক্রমে আগ্রহ থাকায় বেশ উৎসাহী ছিলাম। উৎসাহের আগুনে আবার ঘি ঢালে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া দেশের অন্যত্র দুদকের গণশুনানীতে অভিযোগকারীদের বক্তব্যগুলো।
গণশুনানীর বিষয়ে দুদকের ওয়েবসাইটে তারিখ পূর্বঘোষিত ছিলো। নির্ধারিত তারিখের কয়েকদিন আগে থেকেই শহরে পোষ্টার, কিংবা মাইকিং হয় কি না খেয়াল রাখছিলাম। ১৭ নভেম্বর একজন মোবাইলে পোস্টারের একটি ছবি পাঠালেন। বুঝলাম পোস্টার ছাপানো হয়েছে। যথাস্থানে লাগানো হয়েছে কি না জানা গেলো না। মাইকিং হতে শুনিনি। রঙিন পোস্টারে দুদক সিলেট কার্যালয় ছাড়াও দুই স্থান থেকে অভিযোগ ফর্ম সংগ্রহ ও জমা করা যাবে বলে দেখা যায়। ২৮টি সরকারি অফিসের নাম উল্লেখে ও অন্যান্য সকল সরকারি/ আধা-সরকারি/ স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে হয়রানি বা দুর্নীতির শিকার হয়ে থাকলে অভিযোগ জমা দেয়ার আহবান জানানো হয়।
এছাড়াও জানতে পারি গুগল ফর্ম পূরণ মাধ্যমে অনলাইনেও অভিযোগ গ্রহন করা হয়। তবে অভিযোগ আহবান করে সিলেটের কোনও সংবাদপত্রে দুদকের বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি। শুধুমাত্র ১৭ নভেম্বর একটি সংবাদপত্র সংবাদ আকারে গণশুনানীর খবর ছাপায়। আমি নিজ থেকে পরিচিত কয়েকজনকে মোবাইলে দুদকের পোস্টারটি শেয়ার করলাম।
গণশুনানীর তারিখে যথাসময়ে ভেন্যুতে উপস্থিত হলাম, অনুষ্ঠানও শুরু হলো। মঞ্চে উপবিষ্ট ৯ জন ব্যাক্তি- দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনার (তদন্ত), মহাপরিচালক, সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও তিন পুলিশ কর্মকর্তা একে একে বক্তব্য দিলেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি দুদক চেয়ারম্যান তার বক্তব্যে বললেন অলি-আউলিয়ার সিলেটে দুর্নীতি কাম্য নয়। সেই সাথে জানালেন শুনানীতে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও দুদকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। অতঃপর অনুষ্ঠানের মডারেটর জেলা প্রশাসক সঞ্চালনার দ্বায়িত্ব নিয়ে জানালেন প্রাপ্ত সকল অভিযোগ হতে বাছাইকৃত অভিযোগসমূহে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে।
প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধি বা অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে একে একে ডাকা হলে তারা যাতে মঞ্চে এসে অভিযোগ এর জবাব প্রদান করেন। জেলা প্রশাসক তার নিজ কার্যালয়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ আগে পড়ে শোনান অতঃপর সংশ্লিষ্ট শাখার দ্বায়িত্বশীলরা জবাব প্রদান করেন। জেলা প্রশাসক যখন নির্বাচিত অভিযোগসমূহ পড়ে শোনাতে অভিযোগকারীদের ডাকছিলেন তখন প্রায় অভিযোগেরই অভিযোগকারী অনুপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ গরহাজিরে মামলা খারিজ হবার উপক্রম! কিন্ত না, মডারেটর জেলা প্রশাসক তা হতে দেন নি, অভিযোগটি পড়ে শুনিয়েছেন। অতঃপর ফাঁকা মাঠ পাওয়া অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি বা ব্যক্তি বীরদর্পে বলে চলেন- এমন অভিযোগের সত্যতা নেই, এমন কোন অভিযোগ তিনি পাননি, পেলে ব্যবস্থা নেবেন, ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ইত্যাদি। দুর্নীতির আখড়া ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি তো সক্ষমতার চেয়ে বেশি সার্ভিস দিচ্ছেন বলে মঞ্চে উপবিষ্টদের হতে ধন্যবাদও আদায় করে নিলেন! বোঝা গেলো, এসব মোকাবিলায় তারা ইতিমধ্যে সিদ্ধহস্ত।
যাই হোক, অভিযোগকারী প্রত্যেকের মোবাইল নাম্বার থাকলেও দুদক হতে অভিযোগকারীদের মোবাইলে বা অনলাইনে হোয়াটসঅ্যাপে যুক্ত করার কোন ব্যবস্থা ছিলনা। এসব ক্ষেত্রে উত্তর তো সোজা- উনি আসে নাই আমাদের কি করার আছে! তবে, আমাদের বলার আছে, অভিযোগকারীদের জন্যই তো গণশুনানীর আয়োজন। যদি তারাই না থাকেন বা তাদেরকে সুযোগ থাকতেও প্রযুক্তির সহায়তায় যুক্ত না করা হয়, তবে দুদকের এমন আয়োজন করার ভিন্ন অর্থ আমাদের খুজঁতে হবে।
অনুষ্ঠানে পড়ে শোনানো বেশ কিছু অভিযোগ ছিলো অত্যন্ত অস্পষ্ট। দুদক যখন আগত অভিযোগ হতে বাছাই করে অস্পষ্ট অভিযোগ জেলা প্রশাসককে দিয়ে মঞ্চে পড়ে শোনায়, তখন মঞ্চে উপবিষ্টরা নির্বিকার ছিলেন। কাউকে বলতে শুনিনি, এসব কেন নির্বাচন করা হয়েছে? শ্রোতা হিসেবে তখন আমরা ধরে নেই অভিযোগের নির্বাচক হয় নিজে অদক্ষ কিংবা গণশুনানীতে সময়নষ্টের জন্য এই চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এমন অভিযোগও নির্বাচন করা হয় যেখানে পেনশন কার্ডের ব্যাপারে উত্তর দিতে বি.আর.টি.এ কর্মকর্তাকে মঞ্চে ডেকে নেয়া হয়। বিমানের ভাড়া বেশি কেন, সে বিষয়ে ২টি অভিযোগ শুনানীতে নির্বাচন করা হয়! মঞ্চে ডাকা বিমান কর্মকর্তাকে বলার কিছু নেই, আগ্রহভারে উত্তর দিলেন দুদক চেয়ারম্যান নিজেই। ফারইস্ট ইনস্যুরেন্স বিষয়ে অভিযোগের জবাব দিতে কেউ ছিলেন না, দুদক সিলেটের এক কর্মকর্তা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলেন, নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এছাড়া জেলা রেজিষ্ট্রারকে ডাকানো হয় এমন অভিযোগে- যে বিষয়ে তার কিছু করার নেই। একজন অভিযোগকারীর দুইটি অভিযোগ নির্বাচন করা হয়, অথচ পড়ে শোনানের পর বোঝা গেল কোনটির ই কোন সারবত্তা নেই – শুধু শুধু ডাকানো হয় একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও একটি থানার ও.সি কে। এনআইডি কর্মকর্তাকে ডাকা হয় এমন অভিযোগ বিষয়ে, যেটি নিয়ে অভিযোগকারী উক্ত অফিসেই যোগাযোগ করেননি। ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি চরমে হলেও মঞ্চে পড়ে শোনানো ইস্টার্ন ব্যাংক, চৌহাট্টা শাখার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দিতে ব্যাংকের কেউ গণশুনানীতে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন মনে করেনি। অন্য ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সেগুলো অজানা কারনে শুনানীর জন্য নির্বাচিত করা হয়নি।
অভিযোগ ছিলো দুদক সিলেট এর এক তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও, কিন্তু তা শুনানীর জন্য তা নির্বাচিত না করে দুদক চেয়ারম্যানকে এই বলার সুযোগ করে দেয়া হয় যে, দুদকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ জমা পরেনি! উপস্থিত নাছোরবান্দা অভিযোগকারী এই অবস্থা দর্শনে সরাসরি মঞ্চে উঠে মহাপরিচালকের হাতে অভিযোগটি প্রদান করেন। অনুষ্ঠানস্থলে অভিযুক্ত ব্যক্তি উপস্থিত, তবু গণশুনানী নামক অনুষ্ঠানে অভিযোগটির শুনানী করেননি ঢাকা থেকে আসা দুদকের কর্তাব্যাক্তিগণ। ভাবলাম এভাবেই হয়তো বর্তমানে দন্ডপ্রাপ্ত সাবেক দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরদের মতো দুর্নীতিবাজ দুদক কর্মকর্তাদের চাকুরীকালীন সময়ে স্পর্শের বাইরে রাখা হয়। অতঃপর দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেলে, সংক্ষিপ্ত সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটলো।
অনুষ্ঠান শেষে দুদক চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, ‘তুলনামূলকভাবে অন্যান্য জায়গার চেয়ে দুর্নীতি কম (সিলেটে), দুর্নীতির স্কেলটা কম। সেটা আমার কাছে মনে হয়েছে। আমার ভালো লেগেছে’। আসলে সংখ্যা হিসেবে যতগুলো শূন্যকেই যোগ করা হোক, ফলাফল তো শূন্যই হবে।
দুদক চেয়ারম্যানের মন্তব্য অনেকগুলো শূন্যের যোগফলই বলা চলে। গণশুনানী বিষয়ে সময় নিয়ে পর্যাপ্ত প্রচারনা না করা, অনুপযোগী অভিযোগ শুনানীর জন্য নির্বাচন করে সময়ক্ষেপন, নিজেদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগকে চেপে রাখা, অভিযোগকারীদের ব্যাক্তিগত বা ভার্চুয়্যাল উপস্থিতি নিশ্চিত না করা অর্থাৎ একটি নামসর্বস্ব গনশুনানী করতে যা প্রয়োজন, তাই করা হয়েছে। গণশুনানীর এমন বেহাল দশা দেখে মনে হয়েছে- দুদক চেয়ারম্যানকে কি তাহলে অধিনস্থরা এভাবেই বোকা বানান!
শেষ করবো অনুষ্ঠানস্থলের আরেকটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে। অডিটোরিয়ামের ভেতরে বেশ কিছু শ্লোগানসূচক ব্যানার ঝোলানো ছিলো। একটিতে বড় করে লিখা ‘রুখবো দুর্নীতি, গড়বো দেশ হবে সোনার বাংলাদেশ’, মনে হলো- ভাব প্রকাশে অক্ষম ভুলভাল একটি বাক্য তৈরী করে ব্যানার করা হলো এবং তা হল রুমে প্রদর্শনের জন্য ৫ ঘন্টা ঝোলানো থাকলো, কিন্তু মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত অতিথিগণ কিংবা অডিটোরিয়ামের দ্বায়িত্বে থাকা দুদক সিলেট এর কোন কর্মকর্তার এটি নজরে এলো না! ভাবলাম, এভাবেই হয়তো চোখ থাকিতেও অন্ধ অবস্থায় যুগে যুগে দুদক চলিতে চায়!
লেখক : অ্যাডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ ও জজ কোর্ট, সিলেট।



