ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকায় পাথর লুট করছে কারা?
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮:৩৩:১৮ অপরাহ্ন
আবিদুর রহমান, কোম্পানীগঞ্জ থেকে : কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের (বাঙ্কার) সংরক্ষিত এলাকায় গণলুট চলছেই। প্রতিদিন পাথর তুলছে সহস্রাধিক লোক। ফলে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে ব্রিটিশ ঐতিহ্যের ধারক এলাকাটি। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা দুর্বৃত্তদের আরও উৎসাহিত করছে। এটি রক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত; তারাই এখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি রক্ষা করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকে রোপওয়ে স্থাপন হয় ১৯৬৪ সালে। এ রোপওয়ের ১১৯টি খুঁটি রয়েছে। ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের সংরক্ষিত এলাকার লোডিং স্টেশনকে ‘বাঙ্কার’ বলে ডাকা হয়।
বাঙ্কারের ৩৫৯ একর জমি, অবকাঠামোসহ রেলের স্থাপনা, যন্ত্রপাতি দেখভাল করতে ২০০০ সাল থেকে আনসার বাহিনী দায়িত্বে ছিল। তবে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও বিক্রির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে রেল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আনসার বাহিনীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দায়িত্ব নেয় রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আরএনবি। একজন পরিদর্শক ও দুজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে ৪৮ সদস্যের আরএনবি দল সার্বক্ষণিক অবস্থান করে পাহারায় নিয়োজিত হয়।
তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাতে বাঙ্কারের দায়িত্বে থাকা আরএনবি সদস্যদের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা করে। মারধর করে তাদের মোবাইল, অর্থ ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ৭ আগস্ট বাঙ্কার থেকে আরএনবি সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়। এরপর অরক্ষিত বাঙ্কারে চলে গণলুট। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) ওপর। তাতেও দৃশ্যপট না বদলালে গত ১১ ডিসেম্বর ফিরিয়ে আনা হয় আরএনবিকে। কিন্তু আরএনবির দায়িত্বহীনতা জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
এদিকে, গত সোমবার বাঙ্কারে পাথর তুলতে গিয়ে মাটিচাপায় লিটন মিয়া নামে একজনের মৃত্যু হয়। আরএনবির ৪৯ সদস্যের কেউই এই ঘটনা সম্পর্কে মুখ খুলতে রাজি হননি। আরএনবির উপপরিদর্শক ও ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের ইনচার্জ মো. জসিম উদ্দিন ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা করেন। বাঙ্কারে গিয়ে দুর্ঘটনার কোনো আলামত তিনি দেখতে পাননি বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানান।
জসিম উদ্দিন আরও জানান, ‘বাঙ্কারে রাতে ডিউটি করা রিস্ক। আমাদের লাশ পড়বে। কয়েক হাজার শ্রমিক পাথর তুলে। তাদের আটকানোর সামর্থ্য আরএনবির নেই। বর্তমানে সেখানে থাকার মতো পরিবেশও নেই। আমরা দিনে ডিউটি করি, তখন পাথর লুট হয় না’ বলে মন্তব্য তাঁর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রোপওয়ে বাঙ্কারে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। একেকটি গর্তে শতাধিক লোক পাথর তুলছে। বেলচা, কোদাল ও শাবলের সাহায্যে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে বের করছে পাথর। গর্তের পাশেই স্তুপ করে রাখা হচ্ছে এসব পাথর। পরে বারকি নৌকায় করে নেয়া হয় নদীর পাড়ে। সেখান থেকে ট্রাক-ট্রাক্টরে করে যায় বিভিন্ন ক্রাশার মিলে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ- সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিবি) ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদেই বাঙ্কার খুঁড়ে বিরানভূমি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাঙ্কারের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি ধলাই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পাওয়ার হাউস, আবাসিক ভবন, মসজিদ, স্কুলসহ কয়েকটি স্থাপনা হেলে পড়েছে। কোনোটা ভেঙে পড়েছে। লুট হয়েছে মসজিদের মাইক, ব্যাটারি, ফ্যানসহ সব ধরনের মালামাল। খোয়া গেছে রেলওয়ের মূল্যবান যন্ত্রপাতি।
ভোলাগঞ্জের দুজন বাসিন্দা জানান, পটপরিবর্তনের আগে মানুষ লুকিয়ে পাথর তুলত। এখন প্রকাশ্যে তুলছে। টাস্কফোর্সের অভিযান হয় দিনে, কিন্তু লুটপাট চলে রাতে।
সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরে সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি করছেন কোম্পানীগঞ্জের চাঁনপুর গ্রামের আবু কাউছার। বাঙ্কার নিয়ে ফেইসবুকে তার স্ট্যাটাসের অংশবিশেষ এরকম- ‘স্থাপনাটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা অনন্য ল্যান্ডমার্ক হিসেবে। তবে কতদিন যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই স্থাপনাটি রক্ষা করা উচিত। কোনোরকম বিতর্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্ট্যাটাস নয়। একটা জেনারেশনাল হেরিটেজ (প্রজন্মগত ঐতিহ্য)-এর টিকে থাকা ও টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব বুঝানোই আমার মূল উদ্দেশ্য।’
উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি মো. শওকত আলী বাবুল বলেন, ‘রোপওয়ের পুরো এলাকাজুড়ে দুর্বৃত্তদের আঁচড় পড়েছে। পাথর তুলে এলাকাটিকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। আরএনবি ফিরলেও লুটপাট বন্ধ হয়নি। বিজিবি চাঁদাবাজি করছে। লুটপাটে জড়িত আছে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত কিছু ব্যক্তি। বিএনপিরও আছে কয়েকজন। প্রশাসন এখানে নির্বিকার।’
উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাজী মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসনের ঢিলেমির কারণে বাঙ্কারে গণলুট চলছে। এলাকাটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অথচ পরিবেশ ও জনজীবন রক্ষায় ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি রক্ষা করা উচিত। উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে বাঙ্কার রক্ষার দাবি জানিয়ে আসছি। স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনের সাথে বৈঠক করেছি। নাগরিক কমিটির ব্যানারে গিয়েও কথা বলেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। উল্টো বিএনপিকেই দুর্নাম বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’
বিজিবির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিষয়ে জানতে কালাসাদক কোম্পানি কমান্ডার মুহিব্বুল্লাহর মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়। তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি। বরং বিজিবির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
শতকোটি টাকার পাথর লুট :
ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার থেকে গত পাঁচ মাসে শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে পাথর ব্যবসায় যুক্ত স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন। তবে, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এরকম কোন পরিসংখ্যান নেই। প্রশাসনের সূত্র অনুযায়ী, সরকার পতনের পর থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও বিজিবি ক্যাম্পে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তখন পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এ সুযোগে লুটেরা চক্র বিপুল পরিমাণ পাথর লুট করে নেয়। তবে, পরবর্তীতে নজরদারি বাড়ানো হয়।
টাস্কফোর্সের অভিযান :
বাঙ্কারে লুটপাট ঠেকাতে উল্লেখ করার মতো কয়েকটি অভিযান হয়েছে। গত ২১ অক্টোবর পাথরবহনকারী ১৩৬টি বারকি নৌকা ও ৫০০ ঘনফুট পাথর জব্দ করে টাস্কফোর্স। ৯ জানুয়ারি ১৮১টি নৌকা এবং ২২টি পাথর ওয়াশিং প্ল্যান্ট ধ্বংস করা হয়। ১২ ডিসেম্বর বাঙ্কারে আরএনবির কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের টিম ভিজিট করে এবং টাস্কফোর্সের অভিযান হয়। ২ ডিসেম্বর দশটি নৌকা জব্দ করা হয়। ২৯ নভেম্বর ৬৭ নৌকা বিনষ্ট করা হয়। এছাড়া নিয়মিত অভিযানে জরিমানার পাশাপাশি অসংখ্য বালু-পাথরের বাহন জব্দ করা হয়।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান জানান, বাঙ্কারের নিরাপত্তায় নিজস্ব বাহিনী আছে। টাস্কফোর্সের অভিযান হলে আমরা ফোর্স দিয়ে সহযোগিতা করি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবুল হাসনাত জানান, বাঙ্কারে মাটির নিচে পাথর থাকায় শ্রমিকরা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে। পটপরিবর্তনের পর পাথরখেকো চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। নিয়মিত টাস্কফোর্সের অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না এই কর্মযজ্ঞ। এ বিষয়ে সকল মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।