প্রখ্যাত আলেম আল্লামা ইসহাক মাদানীর ইন্তেকাল, সিলেটে শোকের ছায়া
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৯:০২:৫৪ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন, সিলেটের কৃতিসন্তান শায়খুল হাদিস আল্লামা ইসহাক আল মাদানী আর নেই। তিনি গতকাল সোমবার সকাল ৮টায় সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এর আগে রোববার শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঐ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে ও ৪ মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।
মরহুমের ১ম জানাজার নামাজ সোমবার বিকেল পৌণে ৫টায় সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন মরহুমের বড় ছেলে হাফিজ হাসান বিন ইসহাক আল হাদী। তিনি জানাজার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে লন্ডন থেকে সিলেটে পৌঁছান। বাদ এশা সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জ মইরচা বাউসী গ্রামের ২য় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে বৃহত্তর সিলেটের অভিভাবকতুল্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন ও হাজারো আলেমের উস্তাদ আল্লামা ইসহাক আল মাদানীর ইন্তেকালে সিলেটজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুর খবর শুনে প্রথমে হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে তাঁর বাসায় শিক্ষক-ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ভিড় জমান। বাদ আসর নগরীর ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে মরহুমের ১ম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার কয়েক হাজার মুসল্লী অংশ নেন।
জানাজা পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও সিলেট জেলা আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান। এসময় উপস্থিত ছিলেন, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক ফজলুর রহমান, সাবেক এমপি অধ্যক্ষ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগরী আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সালাম মাদানী, আনজুমানে খেদমতে কুরআন সিলেটের সভাপতি প্রফেসর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ একরামুল হক, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক জালালাবাদের সম্পাদক মুকতাবিস-উন-নূর, আনজুমানে খেদমতে কুরআন সিলেটের সহ-সভাপতি হাফিজ আব্দুল হাই হারুন ও সাধারণ সম্পাদক হাফিজ মিফতাহুদ্দীন আহমদ, শিক্ষাবিদ লেঃ কর্নেল (অব.) সৈয়দ আলী আহমদ, সোবহানীঘাট ডিওয়াই কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মাওলানা কুতবুল আলম, শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা পাঠানটুলার প্রিন্সিপাল মাওলানা লুৎফুর রহমান হুমায়দী, রাজনগর দারুচ্ছুন্নাহ ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক, সুনামগঞ্জ আলহেরা ফাজিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ফুলবাড়ী আজিরিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা জাকির হোসাইন ও সিলেট মহানগর ইমাম সমিতি সভাপতি মাওলানা হাবিব আহমদ শিহাব প্রমুখ।
এছাড়া জানাজার নামাজে, সিলেটের বিভিন্ন স্তরের আলেম-উলামা, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক-ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কয়েক সহ¯্রাধিক মুসল্লী অংশ নেন।
মরহুম আল্লামা ইসহাক আল মাদানী উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ও দ্বীনের দায়ী ছিলেন। হাজারো আলীমের উস্তাদ, ইলমে নববীর জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, উম্মাহর সম্পদ ছিলেন। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যবাহী দারুল ইফতা সৌদি আরবের সাবেক মুবাল্লিগ। শিক্ষা জীবনে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে শায়খ ইসহাক আল মাদানী বিশ্ববিখ্যাত মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি দীর্ঘদিন শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা পাঠানটুলায় শায়খুল হাদিস হিসেবে ইলমে দ্বীনের খেদমত করেন।
তিনি ৯ অক্টোবর ১৯৫৩ ইংরেজি সিলেটের গোলাপগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারতের মুফতি মাযহারুল ইসলাম ওসমান কাসিমী কর্তৃক রচিত এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত ইসলামী মনীষীদের ছাত্রজীবনের বর্ণনা সম্বলিত বই: বিখ্যাত ১০০ ওলামা মাশায়েখের ছাত্রজীবন। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ৩৮৪ পৃষ্ঠার বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। যে গ্রন্থের শুরুতেই স্থান পেয়েছে, ইমাম আযম আবু হানীফা (র:) ও আল্লামা ইমাম গাজ্জালী (র:)-এর জীবনী। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের ২৪৭-২৫০ পৃষ্ঠায় শায়খ ইসহাক আল মাদানী (রহ.) সাহেবের জীবনী তুলে ধরা হয়েছে। শিরোনাম: ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক হযরত মাওলানা শায়খ ইসহাক আল-মাদানী। বইটিতে মদীনা ইসলামী ইউনিভার্সিটি, মক্কা উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি, রিয়াদ জামেয়া সাউদ ইসলামী ইউনিভার্সিটি এবং মিশরের আল আযহার ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত পাক বাংলা ভারতের অন্য কোনো স্কলারের জীবনী স্থান পায়নি।
আল্লামা ইসহাক আল মাদানী মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্য অনুষদে ১৯৮৩ সালে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বিরল সম্মানের অধিকারী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে ১ম ব্যাচের স্কলারশিপপ্রাপ্ত (১৯৭৮) কৃতী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগ থেকে এমএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন এওয়ার্ডপ্রাপ্ত মেধাবী আল্লামা ইসহাক ঢাবির কলা অনুষদে সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।
সৌদি দারুল ইফতার সাবেক মাবউছ আল্লামা ইসহাক আল মাদানী সৌদি আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইসলামী স্কলার হিসেবে প্রায় ৩৭ বছর (১৯৮৩-২০২০) বাংলাদেশ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার (পাঠানটুলা, সিলেট) প্রতিষ্ঠাকালীন শায়খুল হাদীস হিসেবে দীর্ঘদিন জ্ঞানের আলো বিতরণ করেছেন। তৈরি করেছেন অসংখ্য আলেম- যাঁরা দেশে-বিদেশে ইসলামের দ্যুতি ছড়াচ্ছেন।
আল্লামা ইসহাক আল মাদানীর আমন্ত্রণে ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে কাবা শরীফের প্রধান ইমাম ও খতীব শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন সুবায়ল সিলেট সফর করেন। তিন দিনের এই সফরে কাবার ইমামের বক্তব্য সমূহ আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদ করে গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর শিক্ষার্থীরা দূরদুরান্ত থেকে সিলেটে ছুটে আসেন।
ইসহাক আল মাদানী বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীনের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা, সৌদি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্রপরিষদ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৭৮ সালে নিবন্ধিত), লাজনাতুল বুহুছ আল-ইসলামিয়ার সহ-সভাপতি, তাহফীজুল কুরআন শিক্ষাবোর্ড সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, উলামা মাশায়েখ পরিষদ সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আনজুমানে খেদমতে কুরআন সিলেটের সহ-সভাপতি, ইত্তেহাদুল কুররা বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, হাউজিং এস্টেট জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।