কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সীমান্তবর্তী সোনাই নদীতে বাঁধ দিয়ে ওপেন চাঁদাবাজি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৩:৪২:৪০ অপরাহ্ন

আবিদুর রহমান, কোম্পানীগঞ্জ থেকে : ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জের সীমান্তঘেঁষা খরস্রোতা সোনাই নদীতে (বাইরং নদী) মাটি ও পাথরের বাঁধ দিয়ে ওপেন চাঁদাবাজি করছে একটি চক্র। এই বাঁধের ওপর দিয়ে চলছে পাথরবাহী ট্রাক ও ট্রাক্টর। ছাতকের ইছামতী নদী থেকে পাথরভর্তি ট্রাক বাঁধের ওপর দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানীগঞ্জে। প্রতিবার একেকটি ট্রাক থেকে তোলা হচ্ছে তিনশো টাকা করে চাঁদা। আর বাঁধে ট্রাক্টর রেখে নদী খেকে অবৈধভাবে তোলা বালুভর্তি নৌকা থেকে ট্রাক্টরে লোড করা হচ্ছে বালু। প্রতি ট্রিপ বালুর জন্য ট্রাক্টর থেকে তোলা হচ্ছে তিন হাজার টাকা করে চাঁদা। সোনাই নদীর ছনবাড়ী-গাংপার নোয়াকোট পয়েন্টের চিত্র এটি।
সরেজমিন দেখা গেছে, নদীটির ওই অংশে ৩৫০ ফুট দীর্ঘ ও প্রায় ১৮ ফুট প্রস্থ করে মাটি ও পাথরের বাঁধ দেওয়া হয়েছে। মাঝে পানি চলাচলের জন্য ১০ ফুট অংশ নিচু করে রাখা হয়েছে। বাঁধটি টেকসই করার জন্য তার ভাঁজে ভাঁজে এবং দুইপাশে বিপুল পরিমাণ পাথর ফেলা হয়েছে। বাঁধ নির্মাণের ব্যয় তোলার কথা বলে বাঁধের পশ্চিম পাশে গাংপার নোয়াকোট মসজিদের ঘাটে বসে ট্রাক ও ট্রাক্টর থেকে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। এই বাঁধের ওপর দিয়ে প্রতিদিন অন্তত চারশো’ ট্রাক ও ট্রাক্টর বালু-পাথর পরিবহন করে। ফলে এখান থেকে প্রতিদিন তিন লক্ষাধিক টাকার চাঁদাবাজি হয়।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের পালিত সৈনিক ও ছাতকের ইসলামপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মখলিছুর রহমান, তার বড় ভাই ‘বিএনপি নেতা’ দাবীদার আব্দুল কুদ্দুস, ছোট ভাই রফিক আহমদ। এরা একই পরিবারের সদস্য এবং সবাই খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চোরাচালানসহ বহু মামলার আসামি। দুর্গম এলাকা হওয়ায় গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও এদের লুটপাট ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে। ছাতক থানার আলোচিত বুলবুল হত্যাকান্ডের পরও গ্রেফতার না হওয়ায় মখলিস-চক্রের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না।
মখলিস গংদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন চিকাডহর গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে আলীনুর, বনগাও গ্রামের মৃত শাহাব উদ্দিনের ছেলে ইলিয়াছুর রহমান, ছাতকের ১নং ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শফিক মিয়া-সহ কতিপয় দুর্বৃত্ত। এদের চাঁদাবাজী নির্বিগ্নে চালিয়ে যেতে প্রশাসনিক সুরক্ষা দেন ছাতক থানার এসআই সিকন্দর মিয়া ও এসআই শাহাব উদ্দিন। ৫ আগস্টের পূর্ব থেকে এরা ছাতক থানায় কর্মরত থাকায় মখলিস গংদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে বাঁধ থেকে প্রতিরাতে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রশাসনিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন।
সোনাই নদীর পশ্চিম পারে এপ্রোচ সড়কের কাজ শুরু হওয়ার পর বাধের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম শুরু হলে ব্রিজের কাজ কৌশলে আটকে দেয় এই চক্র। এই পধে গাড়ি চলাচল যাতে একদিনের জন্যও বন্ধ না হয়, সে লক্ষ্যে ধনীটিলার পূর্ব পাশে ঈদগাহ’র নীচের অংশের কালভার্ট ভেঙে ফেলে মাটি দিয়ে ভরাট করে নিজগাও, বাগানবাড়ী ও রতনপুরের ফসলি জমির পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে ফসলি জমিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে প্রতি ট্রিপে একেকটি ট্রাক ও ট্রাক্টর থেকে আদায় করা হচ্ছে একশো টাকা করে চাঁদা। কালভার্টটি নির্মাণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বরাদ্দ দেওয়া হলেও এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কারণে সেটা নির্মাণ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মখলিছুর রহমান জানান, এতোদিন এখানে ব্রিজ না থাকায় এলসির পাথর পরিবহনের সুবিধার কথা ভেবেই তাঁরা মাটি ও পাথর ফেলে বাঁধটি নির্মাণ করেছিলেন। কয়েক বছর আগে যখন এই বাঁধ তৈরি হয়, তখন কোনো ব্রিজ ছিলো না। বর্তমানে একটি ব্রিজ হলেও গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। এলসি ব্যবসায়ী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ-প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্মতি নিয়েই বাঁধটি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
চাঁদাবাজির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে কোনো প্রকার চাঁদাবাজি হয় না। বরং গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বাঁধের মেরামতের প্রয়োজনে টাকা তোলা হয়। তবে নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ রাখায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, মাটির বাঁধটির অদূরেই একটি নতুন ব্রিজ হয়েছে। চাঁদাবাজ চক্রের চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখতে ব্রিজটি খুলে দেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে, সোনাই নদীর এই বাঁধের বিরূপ প্রভাব পড়ছে নদীতীরবর্তী জনপদে। ২০২২ এর ভয়াবহ বন্যা ও ২০২৩ এর আকস্মিক বন্যায় কোম্পানীগঞ্জ ও ছাতকের অসংখ্য বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ভেঙেছে। স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বন্যার পানি সরাসরি আঘাত হেনেছে তীরবর্তী এলাকায়। কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। প্রতি বছর নদীভাঙনের কবলে পড়েন রতনপুর, নিজগাঁও, গাংপার নোয়াকোট, বাহাদুরপুর, বৈশাকান্দি, বনগাঁও, ছনবাড়ী ও তৎপার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন।
গাংপার নোয়াকোটের ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান সান্ডুল বলেন, এই বাঁধের ফলে ২০২৩ এর বন্যায় বনগাঁও, শাহ আরেফিন, বাগানবাড়ি, রতনপুর, ধনীটিলা ও পুরান নোয়াকোট রাস্তা ভেঙেছে। ধনী টিলায় একটি কালভার্ট ভেঙেছে। এখনও এগুলো মেরামত করা যায়নি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. ময়না মিয়া বলেন, আমরা বহুবার স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।
ব্যবসায়ী মো. আছদ্দর আলী বলেন, মাটির বাঁধের পাশাপাশি সোনাই নদীর ওপর ২০১২ সালে নির্মিত রাবার ড্যামটি সীমান্তবাসীর জন্য আরেক দুঃখ। এটি কৃষকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। কৃষকেরা আগে যেভাবে সেচ কাজ করতো, এখনও সেভাবেই করে। তাদের লাভের বদলে ক্ষতি হয়েছে। নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ কাজ চরমভাবে ব্যাহত হয়। নাব্য সংকটের কারণে বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের পানি ধারণ করতে পারছে না নদীটি। এই সংকট উত্তরণে প্রশাসনিক পদক্ষেপ জরুরি।
ছাতক থানার ওসি মোখলেছুর রহমান আকন্দ বলেন, বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ বন্ধ করার এখতিয়ার কারও নেই। তিনি নতুন এসেছেন। এখনও ওই এলাকায় যাওয়া হয়নি। তবে বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে জানান।
কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আবুল হাসনাত বলেন, কোনোভাবেই নদীতে মাটির বাঁধ দেওয়া উচিত না। এটা অন্যায়। তিনি ছাতকের এসিল্যান্ডের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান।