এই স্বীকৃতিতে কী হবে, কী হবে না
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০১:১০ অপরাহ্ন

ফায়যুর রাহমান :
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এবছরের অধিবেশনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে অধিবেশনটি ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই অধিবেশনকে (৮০ তম) সামনে রেখেই রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও পর্তুগাল। আর অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, মোনাকো, অ্যান্ডোরা ও বেলজিয়াম। এ নিয়ে জাতিসংঘের ১৫৭টি সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলো।
প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘের মোট সদস্য রাষ্ট্রের ৮১ শতাংশ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও এর ফলাফল আসলে কী দাঁড়াবে? ফিলিস্তিনে কি ইসরায়েলি দখলদারী বন্ধ হবে? যুদ্ধ ও গণহত্যা কি থামবে? ফিলিস্তিনের আকাশে কি স্বাধীতনার পতাকা উড়বে?
অংকটা মোটেও সরল নয়। পশ্চিমা জনগণের যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের চাপে রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ থামাতে তারা কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। গাজা এখনো অবরুদ্ধ। ইসরায়েলি অবরোধে বিশ্ব থেকে খাদ্যপানীয় এসে ঢুকতে না পারায় চলছে দুর্ভিক্ষ। একে তো মাথার উপরে ছাদ নেই, পড়ছে বোমা, তার ওপর পেটও খালি, দানাপানি নাই। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল বলছে, তোমরা এখান থেকে চলে যাও, গাজা খালি করো। নিজ ভূমি ছেড়ে এই ক্ষুধার্ত বনি আদমরা এখন যাবে কোথায়?
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে নতুন করে গাজায় ইসরায়েলি হিংস্রতায় ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যার পর বিশ্বজনমত তৈরি প্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলো স্বীকৃতির ঘোষণা দিলো। তাদের এই স্বীকৃতির ভিত্তি হলো ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান’ ও বেলফোর ডিক্লারেশন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান ভয়াবহতার মুখে আমরা শান্তি এবং দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করছি।’
আচ্ছা, এই স্বীকৃতির ইতিবাচক দিক কী? ইতিবাচক দিক অনেক। এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনের অবস্থান শক্তিশালী হবে। ফিলিস্তিনের ভূমিতে দখলদারির জন্য ইসরায়েলিদের জবাবদিহির মুখোমুখি করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর ওপর দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে কাজ করার চাপ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদেরকে পূর্ণ কূটনৈতিক মর্যাদাসহ দূতাবাস খোলার সুযোগ তৈরি করে দেবে। বাণিজ্য চুক্তিতে অংশগ্রহণের সুযোগ এনে দেবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন অর্জনের পথ তৈরি করবে। দখলদার ও গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ এনে দেবে।
কিন্তু এই স্বীকৃতি যা এনে দেবে না, সেটা হলো, গাজায় যুদ্ধের অবসান হবে না। ইসরায়েলের নৃশংস সামরিক দখলদারিত্ব বন্ধ হবে না। ইসরায়েলিরা এই স্বীকৃতিকে পাত্তা দেবে না। এমনকি যে মুহূর্তে এই স্বীকৃতির ঘোষণা আসছে, সেই মুহূর্তেও ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নৃশংস গণহত্যা চলছে। তবে এই স্বীকৃতি শান্তির পক্ষে প্রথম পদক্ষেপ। বলাই যায়।
পশ্চিমারা এই স্বীকৃতি দিয়েছে বেলফোর ডিক্লারেশন অনুসারে। যে বেলফোর ঘোষণা এসেছিল ১০৮ বছর আগে ব্রিটেনের পক্ষ থেকে। সেই ঘোষণায় ‘ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় আবাস প্রতিষ্ঠায়’ ব্রিটেনের সমর্থন ছিল। এই ঘোষণায় ভর করেই ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, আর ফিলিস্তিনিদের কপাল পোড়ে।
এবার আসুন বেলফোর ডিক্লারেশনে। বেলফোর ডিক্লারেশন ছিল ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। এই ঘোষণার ফলে ফিলিস্তিনিরা তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ ও বহিষ্কৃত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের জন্ম হয়। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণা আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় সমর্থন জানায়। তখন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল ব্রিটেনের হাতে। যেমন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ওই সময় অটোমান সাম্রাজ্যের (ওসমানী খেলাফত) অধীনে ছিল। ব্রিটিশরা অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সেটা দখলে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর বেলফোর ডিক্লারেশন মিত্রশক্তির সমর্থন পায়। সে সময় ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯২২ সালের জুলাইয়ে লীগ অব নেশনস (জাতিসংঘের পূর্ববর্তী নাম) ওই অঞ্চলে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অনুমোদন দেয়। এই অনুমোদনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেন ওই অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব পায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হলোকাস্টের ভয়াবহতা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের চাপ বাড়তে থাকে। দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ঢল নামে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে মধ্যরাতে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মেয়াদ শেষ হয়। ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে অঞ্চলটি ছেড়ে যায়। ওইদিনই ইসরাইল তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
এরপরই শুরু হয় আরব-ইসরায়েলি সংঘাত। যেটা চলছে ৭৭ বছর ধরে। এই ৭৭ বছরে নাহরে উর্দানের (ফিলিস্তিনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জর্ডান নদী) জলে কত রক্তের স্রোত বয়ে গেছে, ফিলিস্তিনের ভূমিতে কত বোমা পড়েছে, কত বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, কত বনি আদম বোমায় ঝাঝরা হয়েছে, কত শিশু ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়েছে, তার হিসেব নেই।
তাহলে ৭৭ বছর পরে এই স্বীকৃতি আসলে কী ফায়দা দেবে? ব্রিটেনসহ পশ্চিমারা চায় ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান’। ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান’ মানে অবৈধ ইসরায়েলকে স্বীকার করেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা। নিজেদের ভূমিতে উড়ে এসে জুড়ে বসা দখলদার ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের এত সংগ্রাম, এত রক্তের নজরানার পরও সেই দখলদারের অস্তিস্ত স্বীকার করেই বসবাস!
১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া ইসরায়েলের জন্মের পর থেকেই দীর্ঘ সংঘাতের ফলে ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা, রাজধানী বা সেনাবাহিনী নেই। দখলদাররা নিতে নিতে মাত্র দুই টুকরা ভূমি তাদের হাতে আছে, এক টুকরার নাম গাজা, অন্য টুকরা পশ্চিম তীর। দুইটা ছিটমহল বলা যায়। মাঝখানের সব জায়গা দখলদার ইসরায়েল নিয়ে গেছে। যেটুকু আছে, সেটুকুকুও খালি করার নির্দেশ দিয়েছে। তার ওপর চলছে ভয়াবহ নৃসংশতা। এমন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির মাধ্যমে বাস্তব পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম ইন্তিফাদার সময় ইয়াসির আরাফাত জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এ সময় ৮০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়, যার বেশিরভাগই আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আরব বিশ্বের দেশ ছিল। সেই সময়ে বেশিরভাগ ইউরোপীয় স্বীকৃতি এসেছিল পূর্বতন সোভিয়েত ব্লকের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলি থেকে। ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত অসলো চুক্তিটি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলিদের মধ্যে প্রথম সরাসরি আলোচনার সূচনা করেছিল, যেখানে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারনা তুলে ধরা হয়েছিল। মানে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান। কিন্তু সেই চুক্তির কোনো বাস্তব ফলাফল দেখা যায়নি। অসলো চুক্তির ৩২ বছর পরে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি কি আসলেই বাস্তব কোনো সমাধান এনে দেবে?
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।