জকিগঞ্জের নোমান হত্যাকাণ্ড : খুনিরাই মামলার বাদী ও সাক্ষী, ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ৫:৪২:১১ অপরাহ্ন
জকিগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা : সিলেটের জকিগঞ্জের কালিগঞ্জ এলাকার বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী নোমান উদ্দিন হত্যা মামলায় নতুন করে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিহতের ভাই রিয়াজ উদ্দিনের দাবি, সন্দেহভাজন খুনীদের স্বজনকে বাদী ও সাক্ষী বানিয়ে মামলা রেকর্ড করায় ন্যায়বিচার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, “যারা হত্যাকারী, তারাই এখন বাদী ও সাক্ষী।”
এ ঘটনায় নিহত নোমানের ভাই, চাচাসহ নিকটতম স্বজনরা পুলিশের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত ও প্রকৃত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার নিহতের ভাই, চাচা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা সিলেটের পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত আবেদন দাখিল করেছেন। এ সময় তারা পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িত আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানান। তখন পুলিশ সুপার আশ্বাস সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায় বিচার নিশ্চিতের আশ্বাস দেন।
লিখিত অভিযোগে তাঁরা উল্লেখ করেন, জকিগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলাটি রহস্যজনকভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। প্রায় ৩০ বছর প্রবাসে থাকার পর নোমান উদ্দিন দেশে ফিরে কালিগঞ্জ বাজার সংলগ্ন নতুন বাড়িতে স্ত্রী, দুই কন্যা এবং শ্যালক হানিফ উদ্দিন সুমনসহ বসবাস শুরু করেন। নোমানের ক্রয়কৃত বাড়িটির অর্ধেক তাঁর স্ত্রীর নামে ও অর্ধেক নিজের নামে ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শ্যালক সুমন বাড়িটি নিজের নামে দলিল করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে পারিবারিক বিরোধ চরমে পৌঁছালে একাধিকবার স্থানীয়ভাবে সালিশ হলেও কোনো সমাধান হয়নি।
পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, এই বিরোধ নিয়েই ঘরে কলহ লেগে থাকত। এমনকি নোমান দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছেন — এমন গুজব ছড়িয়ে শ্যালক সুমন পরিবারকে উত্তেজিত করে তোলে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে হানিফ আহমদ সুমন সহযোগী বাবুর বাজার এতিছামনগর গ্রামের মামই মিয়ার ছেলে মাজেদ আহমদ ও বিয়ানীবাজারের গোলাঘাট গ্রামের তাছকিন আহমদ তাজুলসহ কয়েকজনকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে নোমানকে দোকান থেকে বাড়িতে ডেকে নেন। সেখানে অস্ত্রের মুখে একটি লিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিতে চাপ দেওয়া হয়। নোমান রাজি না হলে তাঁকে মারধর করে একপর্যায়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে পরিবারের দাবি। পরে রাতে লাশ ঘরের ভেতরে বাথরুমে রেখে পরদিন পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ফেসবুকে ‘নোমান নিখোঁজ’ শিরোনামে একটি পোস্ট করেন শ্যালক হানিফ আহমদ সুমন। ওই পোস্ট দেখে ভাই রিয়াজ উদ্দিনসহ স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁরা থানায় গিয়ে নিখোঁজের বিষয়টি জানান। তখন পুলিশ জানায়, এর আগেই শ্যালক সুমন ও শ্যালক মাজেদ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
নোমানের ভাই রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ভাই নিখোঁজের ঘটনায় তাঁরা দু’দিন ধরে থানায় মামলা করার আবেদন করলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। এরপর ১ অক্টোবর ধানক্ষেত থেকে নোমানের লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহতের ভাই দাবি করেন, দাফনের পরদিন তিনি ও চাচা থানায় গিয়ে বাদী হয়ে মামলা করতে চান। কিন্তু এর পরদিনই রহস্যজনকভাবে তাদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে নোমানের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নিকে বাদী করে ‘অজ্ঞাত আসামি’ উল্লেখ করে মামলা রেকর্ড করা হয়। অথচ ঘটনার সময় ওই মেয়ে নিজেই বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার পর শ্যালক হানিফ আহমদ সুমনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও তাকে মূল আসামি হিসেবে এফআইআরে নামোল্লেখ করা হয়নি। একইভাবে ঘটনায় সরাসরি জড়িত বাবুর বাজারের মাজেদ আহমদ ও গোলাঘাট গ্রামের তাছকিন আহমদ তাজুলকেও আসামির তালিকায় রাখা হয়নি।
নোমানের স্বজনরা জানান, জানাজার সময় শ্যালক সুমন, মাজেদ, তাজুলসহ সন্দেহভাজনরা পলাতক ছিলেন। এখন পর্যন্ত সুমন ছাড়া অন্য আসামিদের গ্রেফতার না করায় মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে আলামত নষ্ট করছে।
পরিবারের দাবি, আদালতে খুনি সুমনের জামিন আবেদনের সময় বাদিনী মেয়ে অনাপত্তি পেশ করতে যাচ্ছেন—এমন তথ্য তাঁদের কাছে এসেছে। তাঁদের আশঙ্কা, হানিফ আহমদ সুমনের কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা না হলে মামলাটি ভেস্তে যেতে পারে এবং প্রকৃত খুনীরা পার পেয়ে যাবে।
তাঁরা বলেন, “যারা হত্যাকারী, তারাই এখন বাদী ও সাক্ষী। তারা নিহতের ঘনিষ্ঠজন পরিচয়ের আড়ালে খুন থেকে রেহাই পেতে চায়। কিন্তু নোমানের রক্তের আত্মীয়রা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে প্রস্তুত, প্রয়োজন শুধু উচ্চ পর্যায়ের সুষ্ঠু তদন্ত।”
নোমান উদ্দিনের ভাই রিয়াজ উদ্দিন, চাচা বশির আহমদ চৌধুরী ও আত্মীয় আব্দুল মান্নান বলেন, “আমরা শুধু ন্যায়বিচার চাই। খুনীদের স্বজনদের বাদী ও স্বাক্ষী বানিয়ে মামলা রেকর্ড করায় আমরা হতবাক। এই মামলার স্বচ্ছ তদন্ত না হলে নোমান হত্যার রহস্য চিরতরে চাপা পড়ে যাবে। তাঁরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নিরপেক্ষ ও উচ্চপর্যায়ের তদন্ত এবং প্রকৃত খুনীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম মুন্না জানান, ঘটনায় জড়িত সকল আসামিকে সনাক্ত করতে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।



