জলবায়ু পরিবর্তন, জাল দিয়ে মাছ নিধন
সুনামগঞ্জের হাওরে কমছে মাছের উৎপাদন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ৭:৩২:২৩ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম :
আবাসস্থল ভরাট হয়ে যাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন, অবৈধ জাল নিয়ে মাছ ধরাসহ নানা কারণে সুনামগঞ্জের হাওরসমূহে মাছের উৎপাদন কমছে। পাশাপাশি বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছও। সুনামগঞ্জের মৎস্য অফিসার জানিয়েছেন, হাওর এলাকার গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে জাল পাওয়া যাচ্ছে। সেখানকার শাল্লা উপজেলায় মাছ ধরার ৮০ হাজার ছাই (মাছ ধরার স্থানীয় যন্ত্র) রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। মাছের উৎপাদন কমাতে মূল প্রতিবন্ধক হচ্ছে এগুলো।
এক তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশে সাতটি জেলায় মোট ৩৭৩ টি হাওর রয়েছে। দেশের মোট মাছের উৎপাদনের একটি বড় অংশ আসে হাওর থেকে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকুয়াকালচার ফ্যাকাল্টি অব ফিশারিজ-এর অধ্যাপক ড. মো: শাখাওয়াত হোসেন সুনামগঞ্জসহ সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোতে মাছের উৎপাদন কমে যাবার পেছনে হাওরগুলোতে ধান চাষে কীটনাশকের ব্যবহার ও জাল দিয়ে মাছ ধরাকে মূলত দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, হাওরে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, কোনা জাল, চায়না দুয়ারি ও বেড় জালে ছোট বড় সব ধরনের মাছ ধরা পড়ছে- যা মাছের বংশবিস্তারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, বিল শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে সব মাছ ধ্বংস করা হচ্ছে। কৃষকরা ধান চাষ করার সময় অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন। ফলে হাওরের পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, নির্ধারিত সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায়ও মাছ বংশবিস্তার করতে পারে না। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও হাওরে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। জলবায়ুজনিত কারণে হাওরে নিয়মিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। কখনো অতি বৃষ্টি এবং কখনো অনাবৃষ্টি দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হলে হাওরের বিলগুলো শুকিয়ে যায়। এতে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাছের জীবন চক্রে পরিবর্তন এসেছে। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে মাছের উৎপাদন বাড়াতে তিনি চোরাই পথে জাল আনার সব পথ বন্ধ করা, জলমহাল নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং হাওরে প্রশাসনিক অভিযান জোরদার করার তাগিদ দেন।
সুনামগঞ্জের জেলা মৎস্য অফিসার আল মিনান নূর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর বরাত দিয়ে জানান, সুনামগঞ্জে সবমিলিয়ে ৯৫টি হাওর রয়েছে। পলি পড়ে অনেক হাওরে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। কোনাজাল, বেড়াজালসহ অন্যান্য অবৈধ জাল দিয়ে হাওরে মাছ ধরা হচ্ছে। হাওর অধ্যুষিত উপজেলাসমূহের ঘরে ঘরে জাল রয়েছে-এই তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, অবৈধ জাল ধরতে তারা এখন জাল বিক্রির দোকানসমূহে অভিযান চালাচ্ছেন। ডাটা বেইজ না থাকায় হাওরে মাছের উৎপাদন কমছে না বাড়ছে-এ তথ্য বলা যাচ্ছে না জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, আগামী নভেম্বর থেকে তারা হাওরে মাছের বেইজ ডাটা শুরু করবেন। এটা করা গেলে হাওরে মাছের প্রকৃত চিত্র জানা যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে-এই তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, মাছের উৎপাদন বাড়াতে মাছের আবাসস্থলকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে। জেলা মৎস্য অফিসার জানান, সঠিক সময়ে হাওরে পানি না আসা, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাওরে দেশি প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। সুনামগঞ্জে সবমিলিয়ে এক লাখ ২ হাজার জেলে রয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট চ্যাপ্টারের সেক্রেটারি কাসমির রেজা বলেন, অনেক জায়গায় হাওর বিল ও নদীগুলো ভরাট হওয়ার কারণে মাছের আশ্রয়স্থল কমে গেছে। প্রত্যেকটি হাওরে কিছু অভয়াশ্রম রয়েছে। এইসব অভয়াশ্রমে মাছ ধরা নিষেধ। কিন্তু, সুনামগঞ্জে এইসব অভয়াশ্রমেও ব্যাপকভাবে মাছ ধরা হয়।
জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ অনুযায়ী প্রকৃত মৎস্যজীবীদের বিল ইজারা দেওয়ার কথা থাকলেও, মৎস্যজীবীদের নামে অমৎস্যজীবীরা বিল লিজ আনছে। হাওরে মাছে উৎপাদন বাড়াতে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের বিলের ইজারা প্রদান, হাওরের বিলগুলো ও নদীগুলো খনন করে দীর্ঘ সময় পানি রাখার ব্যবস্থা, হাওরে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা, সেচ দিয়ে বিল শুকিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা, প্রজননকালীন সময়ে মা মাছ ও পোনা মাছ ধরা দুই মাস বন্ধ রাখা, হাওরে মাছের পোনা অবমুক্ত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা, নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, কোনাজাল, চায়না দুয়ারী ও বেড় জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার পরামর্শ তার।
চাহিদা মেটাচ্ছে পুকুরে চাষ করা মাছ
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলার তাহিরপুর, মধ্যনগর, শাল্লা, দিরাই, বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ কোনাজাল ও বেড়জাল দিয়ে মৎস্য আহরণ। আর এসব কোনা জাল ও বেড়জাল দিয়ে ছোট মাছের পাশাপাশি বড় মাছের পোনার নিধন করছে মৎস্য আহরণকারীরা। কখনো কখনো প্রশাসনের নাকের ডগায় জাল ফেলছে অসাধু মৎস্য আহরণকারীরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন অভিযান না থাকায় অবাধে চলছে মৎস্য আহরণ। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর জলাশয়ে এ জালের ব্যবহারে পোনা মাছ নিধন হওয়ায় এ সব উপজেলার বাজারগুলোতে এখন বড় মাছ তেমন মেলে না। এসব উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জাতের মাছের সংকট রয়েছে। পুকুরে চাষকৃত মাছ স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছে। হাওর পারের স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রকার অভিযান না থাকায় অবাধে চলছে পোনা মাছ নিধন।
তাহিরপুর বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী জামালগড় মধ্য তাহিরপুর গ্রামের লগুছ মিয়া বলেন,হাওরের মাছ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে হাওরে অনেক লোক আসেন ঘুরতে। সে সময় অনেকে স্থানীয় বাজারে দেশি মাছ খুঁজেন। কিন্তু দেশি মাছ কম থাকার কারণে আমরা তাদের দিতে পারি না।
মাটিয়ান হাওর জলমহালের মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন,বর্ষার শুরু থেকেই উপজেলার হাওরগুলোতে চলছে কোনাজাল ও বেড়জাল দিয়ে দেশীয় প্রজাতির মা-মাছ নিধন। হাওরগুলোতে যদি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হতো; তাহলে বাজার থেকে এভাবে দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতো না।
দিরাই মাছ বাজারের বিক্রেতা রবীন্দ্র বর্মন বলেন, হাওরে পানি ভর্তি থাকলেও দেশি মাছ পাওয়া যায় না। তাই, পুকুরের চাষ করা মাছই বিক্রি করছি। ওই মাছ বিক্রেতা জানান, হাওরে মাছ না থাকায় অন্যান্য উপজেলাসহ উজান এলাকা থেকে পুকুরের চাষ করা মাছ এনে বিক্রি করছেন তারা। অন্য মাছ না পেয়ে চাষের মাছই চড়া দামে কিনে নিচ্ছেন ক্রেতারা।




