অনেক আসামী জামিনে বের হয়ে পলাতক
সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা : ১৪ মাসে ১৪৫ মামলার একটিরও তদন্ত শেষ হয়নি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ৮:১৩:৩৬ অপরাহ্ন
লবীব আহমদ :
সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় ১৪৫টি মামলা হয়েছে এসএমপি ও সিলেট জেলার বিভিন্ন থানায়। তবে একটি মামলারও অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি আদালতে।
সূত্র জানিয়েছে, এসব মামলায় ৯ হাজার ৯২৫ জন এজহারনামীয় আসামীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে সিলেট নগর পুলিশের মামলা-আসামী ও গ্রেফতার বেশি রয়েছে। মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু না হওয়াতে ইতিমধ্যে অনেক আসামী জামিনে বের হয়ে পলাতক রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব আসামীদের মধ্যে অনেকেই নানা নাশকতামূলক কর্মকান্ডে জড়াচ্ছেন। অন্যদিকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এর দাবি চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যে কয়েকটি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হবে আদালতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ৭ জন, বিয়ানীবাজার উপজেলার ৪ জন ও সিলেট সদর উপজেলার ২ জন শহীদ হয়েছেন। আর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দিনাজপুরের রুদ্র সেন শহীদ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। আলোচিত এসব মামলার অগ্রগতি নিয়ে শহীদদের পরিবারে হতাশা রয়েছে।
সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসএমপির ৬ টি থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় ১০৪ টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে কোতোয়ালী থানায়। সেখানে ৭৩ টি মামলায় ৫ হাজার ৫০৮ জনকে আসামী করা হয়েছে ও গ্রেফতার করা হয়েছে ৩২৬ জনকে। আর সবচেয়ে কম ১ টি মামলা হয়েছে মোগলাবাজার থানায়। সেখানে ১৪৫ জনকে আসামী করা হয়েছে এবং পুলিশ এ পর্যন্ত ২৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। নগরীর জালালাবাদ থানায় ৬ টি মামলায় ৩২০ জনকে আসামী এবং গ্রেফতার হয়েছেন ২৪ জন, এয়াপোর্ট থানায় ২ টি মামলায় ১২৫ জন আসামীর মধ্যে এজহারনামীয় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে অজ্ঞাত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দক্ষিণ সুরমা থানায় ১৩ টি মামলায় ৫১২ জন আসামীর মধ্যে ৬১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর শাহপরাণ (র.) থানায় ৯ টি মামলায় ৬৪৭ জন আসামীর মধ্যে ৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে, সিলেট জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে
ছাত্রজনতার ওপর হামলার প্রতিবাদে এ পর্যন্ত সিলেট জেলা পুলিশের ১১টি থানায় ৪১ টি মামলা করা হয়েছে। আর এজহারনামীয় আসামী করা হয়েছে ২ হাজার ৬৬৮ জনকে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ১৫৫ জনকে। এর মধ্যে ১১ টি হত্যা মামলা। যেগুলোর ৩টি জেলা পুলিশ এবং ৮ টি পিবিআই ও সিআইডি তদন্ত করছে। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত এই মামলা করা হয়।
সিলেটের সবচেয়ে বেশি শহীদের এলাকা গোলাপগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মামলাও হয়েছে। গোলাপগঞ্জে ১৫ টি মামলায় ১ হাজার ৩১১ জনের নামোল্লেখ করে ও ১ হাজার ৩৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। আর এজাহারনামীয় ৪৯ জন ও অজ্ঞাত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলায় ১৫৬ জনের নামোল্লেখ ও ৬০০/৭৯০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করা ৫টি মামলায় এ পর্যন্ত ৬ জন নামীয় ও অজ্ঞাত ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলায় ৪ টি মামলায় ৩০১ জনের নামোল্লেখ করে ও ৭০০/৯০০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে। সেখানে এজাহারনামীয় ৪১ জন ও অজ্ঞাত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কানাইঘাট উপজেলায় ১৩৬ জনের নামোল্লেখ ও ২১৮ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে ৩টি মামলায় এজাহারনামীয় ১ জনকে আটক করা হয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলায় ৪টি মামলায় ২১৭ জনের নামোল্লেখ ও ৪৫০/৬৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে। আর গ্রেফতার করা হয়েছে এজাহারনামীয় ৫ ও অজ্ঞাত ১ জনকে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৩টি মামলায় ১৩১ জনের নামোল্লেখ ও ৪০৭ জনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে। এ মামলায় এজাহারনামীয় ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওসমানীনগর উপজেলায় ১টি মামলায় এজাহারনামীয় ১০৬ জন ও অজ্ঞাত ৫০/৬০ জনকে আসামী করলেও এপর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। বালাগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায়ও একই অবস্থা। বালাগঞ্জে একটি মামলায় ৪৬ জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাত ৪০/৫০ জনকে আসামী করা হয়েছে। আর জৈন্তাপুর উপজেলায় একটি মামলায় ১২ জনের নামোল্লেখ ও ২০/২৫ জনকে অজ্ঞাত রেখে মামলা হলেও কাউকে আটক করা হয়নি।
বিশ্বনাথ উপজেলায় ১৯১ জনের নামোল্লেখ ও ১১০/১৩০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে ২ টি মামলা করা হয়েছে। যেখানে এজাহারনামীয় ৪ জন ও অজ্ঞাত ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ২ টি মামলায় ৬১ জনের নামোল্লেখ করে ৯০/১০০ জনকে অজ্ঞাত রেখে করা মামলায় এ পর্যন্ত এজাহারনামীয় ৫ জন ও অজ্ঞাত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আইনে কি আছে, জানতে চাইলে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আবুল ফজল চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ফৌজধারী কার্যবিধির আইনে আছে ৪ মাসের মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ করতে হবে। একটা মামলায় সর্বোচ্চ ৪ মাসের মধ্যে যদি তদন্ত সমাপ্ত না হয়, তাহলে ওই মামলায় যদি কেউ জেলহাজতে থাকে, তাহলে তাকে জামিনের বিষয়ে কনসিডার করতে হবে। এই সরকার আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন। আইনের শাসন যদি কার্যকর করতে হয়, তাহলে ফৌজধারী কার্যবিধি আছে, সেটাকে যদি আমরা মেইনটেইন করি, তাহলে তো সর্বোচ্চ ৪ মাসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করা উচিত। এই মামলাগুলোতে আসলে আইনের শাসনটা পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক ফয়সাল হোসাইন বলেন, প্রকৃত আসামীদের গ্রেফতার না করা দুঃখজনক। যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রজনতার ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদেরকে গ্রেফতার করা উচিত। প্রকৃত আসামীদের গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আমার আহবান। মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত চার্জশীট দাখিল করার জন্য প্রশাসনকে আহবান জানাই।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো মামলার চার্জশীট দাখিলের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছি। আজকেও আমাদের একটা টিম ঢাকা থেকে আসছিল, উনার সাথে আমরা বসছিলাম। ৫ ই আগস্টের মামলাগুলোতে আসলে বিভিন্ন এভিডেন্সগুলো কালেকশন করাটা অনেকটা কঠিন, এজন্য দেরি হচ্ছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি দেওয়া শুরু করে দিবো। এরপরে ১/২ টা হয়ে গেলে পরপর বাকিগুলোও হয়ে যাবে। আগামী একমাসের মধ্যে আমরা আশা করছি বেশ কয়েকটি মামলার চার্জশীট দাখিল করতে পারবো।’
সিলেটের পুলিশ কমিশনার আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী বলেন, ‘মামলাগুলো তদন্তাধীন আছে। এগুলো আমি ক্লোজলি মনিটরিং করতেছি। এই মামলাগুলো অনেক কমপ্লেক্স মামলা। অনেক মামলায় অনেককে আসামী করা হয়েছে, যাদেরকে সাক্ষী করা হয়েছে তাদেরকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষেত্রে বাদী এসে আবার মামলা এফিডেভিট করাচ্ছে যে ঘটনায় জড়িত ছিল না। একারণেই মূলত মামলাগুলো কিছুটা পিছাচ্ছে। আমরা বেশকিছু মামলার চার্জশীট বা ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার পর্যায়ে চলে আসছি। মামলাগুলোর ভালো অগ্রগতি আছে। হয়তো নভেম্বর মাস থেকেই এগুলোর রিপোর্ট যাওয়া শুরু হবে।’




