বিশেষ লেখা
তাঁর আদর্শেই আমাদের পথচলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ৮:০৩:৫৪ অপরাহ্ন
আব্দুল হাই :
তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করা যায় বেশ কয়েকটি বিশেষণ। কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে তাঁর যে পরিচয়টি সবচেয়ে বড়, সেটা হচ্ছে তিনি আমার মা; মমতাময়ী মা। আজ থেকে ১৭ বছর আগে আমার মা বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। মা হারানোর বেদনায় আড়ষ্ট আমি এই এতোগুলো বছর। এই সময়ে, প্রতিটি মুহূর্তে আমি মায়ের শূন্যতা অনুভব করেছি। অনুভব করেছি মা হারানোর বেদনা।
জাগতিক নিয়মের কঠিন নিগড় থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই। এই নশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে ধ্বংসের জন্য। ধ্বংস হবে সব সৃষ্টি। ধ্বংস হবে মানুষ-প্রাণিকূল। আজ যা বর্তমান, কাল তা অতীত। এভাবে আজকের সব ঘটনা, সুন্দর স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। আজ যা কিছু দৃশ্যমান, কাল তা হয়ে যাবে নিশ্চিহ্ন। অর্থাৎ মহাকাল সবকিছুই সৃষ্টি করে ধ্বংস করার জন্য। আজ যে মানুষটি হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ নিয়ে দিন যাপন করছে, সে-ও একদিন বিস্মৃত হয়ে যাবে সবার কাছে। এটাই হচ্ছে সৃষ্টির বিধান। এই ধারা চলে আসছে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকেই। চলবে অনাদিকাল ধরে। এই বৃত্ত থেকে মুক্ত হওয়ার শক্তি নেই কারও। এভাবে পৃথিবীতে কতোজন এলো আর গেলো; তার হিসাব রাখে ক’জনে? ক’জনের কথা মনে রেখেছে পৃথিবী?
অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। এই আসা যাওয়ার খেলায় কেউ কেউ মানুষের মনের মধ্যে ঠাঁই করে নিতে সক্ষম হন কেবলই নিজেদের কর্মগুণে। তেমনি একজন হচ্ছেন মহীয়সী রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি ছিলেন এই অঞ্চলের প্রাচীন পত্রিকা বহুল প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাক-এর সফল সম্পাদক। তিনি ছিলেন যেমন একজন মহীয়সী নারী, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মব্যস্ত ও সদাসর্বদা গোছানো-পরিপাটি একজন নারী। আমাদের ঘরে-পরিবারে সবার মন-মননে তাঁর ব্যক্তিজীবনের অনুকরণীয় সব আদর্শের ছাপ আজও বিদ্যমান।
আমার মায়ের মৃত্যুর পর দৈনিক সিলেটের ডাক সম্পাদনার দায়িত্ব আসে আমার ওপর। এই দায়িত্ব পালনকালে প্রতিটি মুহূর্তে আমি অনুভব করছি তাঁর অস্তিত্ব; একজন নারী হয়েও তিনি কী গুরুদায়িত্বই না পালন করেছেন। দৈনিক সিলেটের ডাক এই অঞ্চলের গণমানুষের অতি প্রিয় ও বিশ্বস্ত পত্রিকা। এটি কোটি মানুষের মুখপত্র। সিলেটের মানুষের কাছে পত্রিকা মানেই সিলেটের ডাক। কারণ এই পত্রিকাটি বিগত ৪০ বছর ধরে সিলেটবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে আছে। এই অঞ্চলের ন্যায্য দাবি দাওয়ার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রাখার কারণে সিলেটের মানুষ এই পত্রিকাকে নিজেদের কন্ঠস্বর হিসেবেই মূল্যায়ন করে। আর এই সিলেটের ডাককে এই অবস্থানে নিয়ে আসতে, পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন আমার মা। একজন বিচক্ষণ সম্পাদক হিসেবে তিনি তাঁর অবস্থানকে গড়ে তুলেছিলেন। পত্রিকার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, নিয়েছেন নানা পরিকল্পনা। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এখনও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সম্মুখে। আমার মায়ের সেই পরিশ্রম-পরিকল্পনা সফল হয়েছে, এটা বলতেই হবে। কারণ আজ সিলেটবাসী ঘুম থেকে জেগেই প্রথমে যা খুঁজেন তা হলো দৈনিক সিলেটের ডাক। আমার মা নিরলস শ্রম দিয়েছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। তাঁর মেধা ও শ্রমেই এখন সিলেটবাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে দৈনিক সিলেটের ডাক। অবশ্য এর পেছনে রয়েছে আমার বাবা দানবীর ডক্টর রাগীব আলীর অনিঃশেষ সহযোগিতা। আমার বাবা রাগীব আলী এই উপমহাদেশের মধ্যে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত একটি আলোকিত নাম। তাঁর দানে-অবদানে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে উপকৃত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। প্রতিনিয়ত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আলোর দীপ্তি।
আমার বাবা রাগীব আলীর কর্মময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন সব সময় আমার মা বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি ছিলেন বাবার প্রধান পরামর্শক। সকল কাজে বাবাকে পরামর্শ দিতেন, সাহস দিতেন; সকল মহৎ কাজে অনুপ্রাণিত করতেন।
আমার এই মমতাময়ী অনন্য গুণে গুনান্বিত মা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। বিগত ১৭ বছর মা-হীন জীবনে বেদনাবিধুর দিন কাটাচ্ছি; যে কষ্ট কাউকে দেখানো যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। একজন বিশাল-উদারমনা মানুষের পথিকৃত ছিলেন আমার মা। মানুষের জন্য ছিলো তাঁর গভীর মমতা। কোন মানুষ কোন প্রয়োজনে এসে তাঁর কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেনি। একজন দিলখোলা মানুষ হিসেবে তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে মিশতেন-একাত্ম হয়ে যেতেন। কথা বলতেন; শুনতেন। ধনী-গরীব কোন পার্থক্য ছিলোনা তাঁর কাছে। আশ্রয়হীন মানুষের পরম নির্ভরতা ছিলেন তিনি। তাদের কাছে তিনি ছিলেন ভরসার জায়গা। সর্বোপরি পরিবারের সদস্যদের প্রতি ছিলো তার সীমাহীন দরদ-সহানুভূতি। আমার বাবা তাঁর ওপর যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে আস্থা রাখতেন। মায়ের পরিকল্পনাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। ফলে আমাদের পরিবারে অনাবিল সুখ-সমৃদ্ধি বিরাজ করতো সর্বক্ষণ।
মা চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। এই শূন্যতা পূরণ হবার নয়। জগৎ-সংসারের নিয়ম এটাই। বৈষয়িক সম্পদ-সমৃদ্ধি যতোই হোক, মা হারানোর বেদনা তাতে লাঘব হবার নয়। জানি মা আর আসবেন না। শুধু তাঁর ছায়া পড়ে থাকবে আমাদের মাঝে সারাটি জীবন। আজ মায়ের সপ্তদশ মৃত্যুবার্ষিকী। মায়ের মৃত্যুর এই বেদনাবিধুর দিনে মহান আল্লাহ পাকের কাছে তাঁর জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করছি। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতের উচ্চাসনে সমাসীন করুন। আমিন।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক।