স্কুল ফিডিং কর্মসূচি প্রসঙ্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ৬:২৫:৫৪ অপরাহ্ন

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী :
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অভিমত বিশ্লেষণ পাতায় গত ৭ জুন ২০২৩ইং ‘স্কুলে অভুক্ত শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষতি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে প্রাথমিকে কোমলমতি শিশুরা অভুক্ত থেকে কিভাবে শিক্ষা লাভ করছে তার একটি চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনটির সার সংক্ষেপ হচ্ছে এই-
রাজধানীর তুরাগে বাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ক্লাস করতে এসেছে ৬৩ জন শিশু। তাদের মধ্যে নাশতা করে এসেছে অর্ধেকের মতো। ২৯ জন জানাল, তারা খেয়ে আসেনি। কেউ কেউ বাসা থেকে নাশতা এনেছে। কেউ নিয়ে এসেছে টাকা, কিছু কিনে খাবে। অনেকেই আবার জানাল, স্কুল শেষে বাসায় ফিরে তারা সকালের নাশতা করবে। কথা হলো প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও। ৫০টি শিশুর মধ্যে ২৪ জন না খেয়ে এসেছে ক্লাসে। এদেরও অনেকে বাসায় ফিরে খাবে। বাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন গত ১৬ মে ২০২৩। গত ১৬, ১৭ ও ১৮ মে ২০২৩ এরকম পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক- তুরাগের বাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের বাইলজুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গুলশানের ছোলমহিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শাহজাদপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কথা বলেছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে। তাতেই জানা গেল, শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ না খেয়ে ক্লাসে আসে। উক্ত পাঁচটি বিদ্যালয়ই আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর- বাস্তবায়িত ‘দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি’ বা স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় ছিল। প্রকল্পটির আওতায় শিশু শিক্ষার্থীদের ৭৫ গ্রাম করে ফটিফায়েড বিস্কুট (১০টি) দেওয়া হতো। এ বিস্কুট একেকটি শিশুকে প্রতিদিন ৩৩৮ কিলোক্যালরি করে শক্তি যুগিয়েছে। ২১ বছর ধরে চলা সেই কার্যক্রম গত বছরের (২০২২ সালের) জুনে বন্ধ হয়ে যায়।
‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯’ অনুসারে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদার (ক্যালরি) ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে আসার কথা। শিক্ষকেরা বলেছেন, যখন বিস্কুট দেওয়া হতো, তখন দরিদ্র এই শিশুদের বাড়ি থেকে নাশতা আনার দরকার পড়তো না। বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রবণতাও ছিল কম। স্কুল ফিডিং কার্যক্রম পরিচালিত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র শিশুদের ভর্তি, উপস্থিতি ও শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করার হার বাড়ানো, ঝরে পড়া কমানো, শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও শিক্ষার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে। প্রকল্পটি সর্বশেষ বাস্তবায়িত হচ্ছিল ৩৫ জেলার ১০৪ উপজেলায়। ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩২ লাখ ৩১ হাজার শিশু শিক্ষার্থী এ প্রকল্পের আওতায় পুষ্টিকর বিস্কুট পেত। দেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। সেগুলোতে ১ কোটি ৩৩ লাখ শিক্ষার্থী পড়ছে। সরকার বলছে, সীমিত সংখ্যক স্কুলে নতুন করে কার্যক্রমটি আবার চালু হবে, তবে ব্যাপক পরিসরে শুরু করার পরিকল্পনা নেই।
বাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির পর এই প্রতিবেদক প্রথম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তারের সঙ্গে তাদের বাড়িতে গেলেন। স্কুল থেকে বাউনিয়ার আদর্শ পাড়ায় তাদের বাড়ি হাঁটা পথে ২০ মিনিট। যেতে যেতে কথা হলো শারমিনের সঙ্গে। সে বলল, মাঝে মধ্যে তাকে নাশতার জন্য টাকা দেওয়া হয়। সেদিনও মা দিয়েছিলেন। তবে নাশতার টাকা দিতে পারলেও অংকের খাতা কেনার টাকা দিতে পারেননি। তাই সে নাশতার টাকায় অংকের খাতা কিনেছে। সারি বাঁধা কয়েকটি ঘর। তার একটিতে নবজাতকসহ তিন সন্তান নিয়ে শারমিনের মা-বাবা ভাড়া থাকেন। মা রোজিনা বললেন, তৃতীয় সন্তানটির জন্মের পর থেকে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। এ জন্য ছেলেমেয়েদের না খেয়েই সকালে স্কুলে যেতে হচ্ছে। আগে স্কুলে বিস্কুট দেওয়া হতো। সেটা চলতে থাকলে তার মতো দরিদ্র মানুষের খুবই উপকার হতো। রোজিনা আগে কাজ করতেন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন পারছেন না। সংসারে তাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দারিদ্র্য। ছেলেমেয়েরা এখন সবজি পায় না, শুধু নামেমাত্র ডাল-ভাত খায়। বাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২০। দরিদ্র ও শ্রমজীবীদের সন্তানই বেশি। সকালের পালায় বহু শিক্ষার্থীকেই না খেয়ে আসতে হয়। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে বাইলজুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫২। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, সকালের পালায় বেশির ভাগ শিশুই অভুক্ত অবস্থায় আসে। ক্ষুধাপেটে পড়াশোনা, খেলাধুলা- কিছুতেই মন বসে না, কিছুই ভালো মতো হয় না। পুষ্টিবিদদের মতে, ‘এই দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো থাকেই, প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান না থাকায় পড়াশোনাও বিঘিœত হয়। সকালের নাশতা শিশুর জন্য অপরিহার্য। রুটি, ডিম, সবজি, দুধের সমন্বিত নাশতা শিশুদের জন্য আদর্শ। অন্তত রুটি আর ডিম খেতে পারলেও শর্করা ও আমিষের চাহিদা মেটে। শিশু দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায়, অম্বল হয়, পেটে ব্যথা ও বমি বমি ভাব হয়। শারীরিক এই অস্বাচ্ছন্দ্য পড়াশোনা থেকে শিশুর মনোযোগ কেড়ে নেয় এবং শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাধা দেয়।’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘বিশ্বজুড়ে স্কুল ফিডিং পরিস্থিতি ২০২২’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে এই সুবিধার আওতায় আছে ৪১ কোটি ৮০ লাখ শিশু। শিশুরা খাদ্য সংকটের চলমান কঠিন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। ৭৯টি দেশের ১৫ কোটির বেশি শিশু ও কম বয়সী মানুষকে ক্ষুধা নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। স্কুল মিল কর্মসূচি বড় ধরনের সামাজিক সুরক্ষায় পরিণত হয়েছে, যা খাদ্য সংকটে থাকা পরিবার ও তাদের শিশুদের জীবনে পরিবর্তন আনার শক্তিশালী সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (বিআইআইডি) কাজ করে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পুষ্টি নিয়ে। তারা ৩৫ জেলায় ৬০০ পুষ্টি ক্লাব বানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদ উদ্দিন আকবর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, কোনো কোনো দরিদ্র পরিবার দিনে দুই বেলার বেশি খাবার দিতে পারে না। দিনের প্রথম খাবারটা তারা স্কুলের শেষেই দিয়ে থাকে। শহরের চেয়ে গ্রামে, বিশেষ করে সিলেট, রংপুর ও নীলফামারীতে অভুক্ত শিশুর স্কুলে আসার সংখ্যা অনেক বেশি। শরীরচর্চা ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সময়ে অভুক্ত শিশুদের জ্ঞান হারিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। দেখা গেছে, স্কুল ফিডিং প্রকল্প শিশুদের পড়াশোনায় ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিল। দরিদ্র এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের হার বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ছাত্র উপস্থিতির হার বেড়ে হয়েছিল ৮৯ শতাংশ, ছাত্রীদের ৯০ শতাংশ। ঝরে পড়ার হার কমেছিল প্রায় ৩ শতাংশ। প্রতিবেদন তৈরিতে ১৩ জেলায় প্রকল্পভুক্ত ৩১২টি বিদ্যালয়ের তথ্য নেওয়া হয়।
লেখক : কলামিস্ট।