ওজনে কম দেওয়ার পরিণতি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ৮:৪৩:০৩ অপরাহ্ন
মো. আব্দুশ শহীদ নেগালী :
রাসুলে করীম (সা.) বলেছেন, কোন জাতি যখন ওজনে কম দেওয়া শুরু করে, তখন সে জাতির উপর মহান আল্লাহ তায়ালা দুর্ভিক্ষ ও মূল্যবৃদ্ধি জনিত গজব নাযিল করেন। ওজন বা পরিমাপে কি কেউ কাকে কম দেয়, এ প্রশ্ন করলে অনেকে বলবেন- না। কেননা আমরাতো সঠিক ওজন দেখে ক্রয়-বিক্রয় করছি। কিন্তু ওজনে কম দেওয়ার যে অনেক অজানা পদ্ধতি রয়েছে তা কিন্তু আমাদের জানা নেই।
কুরআন সুন্নার আলোকে এ সকল পদ্ধতিগুলো আলোচনা করবো এবং এ কলামের শেষের দিকে আলোচনা করবো, ওজনে কম দিত এমন এক জাতির ভয়াবহ পরিণতির কথা।
কোন পদ্ধতিতে আমরা ওজন বা পরিমাপে কম দেই তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে পেশ করছি। আমরা যদি বিশ্ববাজারের দিকে নজর দেই তাহলে তখন দেখতে পাই, কোন কোন সময় হাতে গনা দু-একটি খাদ্যদ্রব্য বা পণ্যের মূল্য যুক্তিসঙ্গত কারণে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। কিন্তু ঐগুলোর সাথে খুড়া যুক্তি দেখিয়ে বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে অনেক খাদ্যদ্রব্য বা পণ্য সামগ্রীর দাম। কোন কারণ ব্যতিত পুজিপতি হবার মানসে, প্লান-পরিকল্পনা করে যদি কোন মহল এভাবে পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি করে থাকে, তাহলে এটা হচ্ছে ওজন বা পরিমাপে কম দেবার শামিল। কেননা ক্রেতামহল মূল্যের পরিমাণে দ্রব্য কম পাচ্ছে।
মনে করি এক প্যাকেট গুড়ো মসলা, গুঁড়ো দুধ বা তৈল জাতীয় পদার্থে বডিতে মূল্য বেধে দেওয়া হয়েছে (দুই শত টাকা) ২০০ টাকা। কোন কারণ ব্যতিত পর্যায়ক্রমে যদি ঐ সকল পণ্য ২১০-২২০-২৩০ টাকা হারে দাম বৃদ্ধি করে বিক্রি করা হয় তাহলে এটাও হচ্ছে ওজন বা পরিমাপে কম দেবার মত অপরাধ। কেননা তাতে; রয়েছে শোষণ নীতি, যা পরিষ্কার হারাম।
কোন কাঁচামাল বিক্রেতা যদি ভাল ভাল মালগুলো উপরে বা সামনের দিকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, আবার ক্রেতাকে দেবার বেলায় আড়াল থেকে যদি ভাল-মন্দ মাল মিশ্রিত করে বিক্রি করে সেটাও হচ্ছে ওজনে কম দেবার মত অপরাধ। কেননা সে মূল্য দিচ্ছে ভাল মালের কিন্তু সে পাচ্ছে মন্দ মিশ্রিত মাল। টাকার ওজনে মাল কম পাচ্ছে। কোন কোম্পানি যদি ২০% কমিশনে মাল বিক্রি করে কোন ব্যবসায়ীর কাছে আবার ঐ ব্যবসায়ী শূন্য কমিশনে যদি ক্রেতার কাছে দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে মাল বিক্রি করে তাহলে এটাও হচ্ছে পরিমাপে কম দেবার শামিল। কেননা অধিক মুনাফা ইসলাম কখনও অনুমোদন করে না।
স্থানীয় বাজারের দিকে যদি আমরা গভীর দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখবো যে একটি পণ্য এক মহাজন বিক্রি করছেন ২৫০ টাকা আবার ঐ পণ্য অন্য মহাজন কাউকে না বলার শর্তে তার আপন কারো কাছে বিক্রি করতেছে ২২০ টাকা। তাতে কি প্রমাণিত হয় না যে কি রকম কৌশলে ক্রেতাদেরকে পরিমাপ বা ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে।
গুদামজাত করে পণ্য সামগ্রীর অভাব দেখিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করাও ওজনে কম দেবার মত অপরাধ। যে সমস্ত পণ্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমবে না, ঐ সমস্ত পণ্যের দাম দেখা যায় হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেয়ে যায় যদি কোন মহল গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এরকম জগণ্যতম নীতি অবলম্বন করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে যে ওরা শোষণ নীতির সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে গেছেন। এরকম উপার্জন নীতি ডেকে আনবে কঠিন থেকে কঠিন সমস্যা।
অনেকে হয়তো বলবেন স্বল্প লাভে পণ্য বিক্রি করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে উন্নতি সম্ভব নহে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহতায়ালার প্রদত্ত উদ্ধৃত তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা মুমিন হও (সুরা হুদ ৮৬) অর্থাৎ মূল্য পরিমাণ দ্রব্য ঠিকমত দেবার পর যে লভ্যাংশ উদ্ধৃত থাকবে তা স্বল্প হলেও তোমাদের জন্য তা উত্তম ও বরকতময়। মহান আল্লাহ তায়ালা তাতে বিরাট আকারে বরকত দান করবেন।
হযরত উমর (রা.) জনৈক ব্যক্তিকে তাড়াহুড়া করে নামায শেষ করতে দেখে বললেন, তুমি আল্লাহর প্রাপ্য ঠিকমত আদায় করনি। তুমি আল্লাহকে ওজনে কম দিয়েছ। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক (র.))
সুরা হুদের ৮৫নং আয়াতের তাফসিরে পাওনাদারদের হকে ত্রুটি করাকে ওজন কম দেওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এমন কি পদমর্যাদা অনুযায়ী কাউকে সম্মান না দেওয়াকেও ওজনে কম দেবার মত অপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহর গজবে ধ্বংস হওয়া মাদইয়ান অধিবাসিদের মধ্যে শিরকি কার্যকলাপের পাশাপাশি লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিমাপে কম দেবার মত উপরোক্ত কলাকৌশল তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
মহান আল্লাহ পাক বলেন, আমি মাদইয়ান অধিবাসিদের প্রতি (বর্তমান পূর্ব জর্ডান) তাদের ভাই হযরত শোয়াইব (আ.) কে প্রেরণ করেছি। সে বললো হে আমার সম্প্রদায় তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের জন্য আর কোন উপাস্য নেই। আর তোমরা পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না। আজ আমি তোমাদেরকে ভাল অবস্থায় দেখছি। কিন্তু আমি তোমাদের উপর এমন একদিনের আযাবের আশংকা করছি যে- দিনটি পরিবেষ্টন কারি (সুরা হুদ ৮৪)
হযরত শোয়াইব (আ.) মাদায়েন অধিবাসিদেরকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য এবং পরিমাপে ও ওজনে কম দেবার মত হীন নীতি পরিহার করার জন্য বহু দিন পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়েও কোন সুফল পাওয়া যায়নি বিপরিতে তারা বলতে যাকে আমাদের পূর্ব পুরুষদের এরকম আক্বেদা ও নীতি আমরা পরিহার করবো না। তুমি বার বার আমাদেরকে যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছ তোমার কথায় যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে সে আযাব এনে দেখাও।
তাদের এহেন হঠকারিতা দেখে মহান আল্লাহ তায়ালা আদ, ছামুদ ও কউমে লূতের মত তাদেরকেও এ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার মনস্থ করেন। সাথে সাথে গজব এসেই গেল। প্রথমে মাদইয়ান শহরে সীমাহীন হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে দেন তখন তারা গরমে ছটফট করতে শুরু করে। মাদায়েন এলাকার পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করে এবং সমস্ত জঙ্গল মেঘমালায় ঢেকে যায়। এ দৃশ্য দেখে খোদায়ী অপরাধিরা শান্তির আশায় কোনরূপ গ্রেপ্তারী পরওয়ানা ছাড়াই সে জঙ্গল নামক বধ্যভূমিতে গিয়ে পৌঁছে। সাথে সাথে মেঘমালা থেকে ঝরতে থাকে অগ্নি বৃষ্টি এবং নিচ থেকে শুরু হয় ভূমিকম্প। নিমিষেই সে অপরাধিরা মাটির সাথে মিশে যায়। এ বধ্যভূমির দিকে তাকালে মনে হত যে এখানে কোন গাছ-বৃক্ষ তরুলতা কখনও জন্মায়নি এবং কোন মানব দানব এখানে পদার্পণ করেনি।
এ কলাম থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কোন কারণ ব্যতিরেখে খাদ্য-দ্রব্য বা পণ্য সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি মানে টাকার পরিমাণে মাল কম দেওয়া যার অর্থ হচ্ছে কৌশলে ওজনে বা পরিমাপে কম দেওয়া। তার পরিণাম হচ্ছে দুর্ভিক্ষ ভূমিকম্প, মূল্য বৃদ্ধি জনিত গজব। বর্তমানে একটি আওয়াজ উঠেছে যে, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কিছু সংখ্যক পণ্যের দাম বেড়েছে। তাও গজবের একটি আলামত। তাছাড়া আমরা অনুভব করছি আমাদের দিকে ভয়ানক রূপ নিয়ে ধেয়ে আসছে দুর্ভিক্ষ ও ঘন ঘন ভূমিকম্প। তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে শোষণ নীতি ও পুঁজিপতি হবার নেশা পরিত্যাগ করে ব্যবসা বাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার দিকে নেমে আসতে হবে। এতে প্রয়োজন সকল মহলের সহযোগিতা।
লেখক: শিক্ষক