মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বাড়িঘর পানির নিচে, চরম দুর্ভোগ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩১:১১ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : টানা বর্ষণে সিলেট অঞ্চলে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। বিপদসীমা ছাড়িয়েছে সিলেটের কয়েকটি নদীর পানি। ইতোমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, জুড়ী, রাজনগর, কমলগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বাড়ি ঘর ও ফসলি জমি। লোকজন চরম দুর্ভোগের শিকার। হবিগঞ্জের মাধবপুরেও সোনাই নদীর পাড় উপচে রোপা আমন, সবজি আবাদসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। দুপুর ১২টার পর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও কমে এসেছে। তবে বাড়ছে সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টের নদ-নদীর পানি। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সূর্যের দেখা মেলেনি।
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী শুক্রবার পর্যন্ত সিলেটসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চলে হালকা থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, সিলেটে বৃষ্টিপাত কমে এলেও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। সিলেটের বৃষ্টিপাতের ওপর এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নির্ভর করে না। মূলত ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় পাহাড়ি ঢলের ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে জানান তিনি।
মৌলভীবাজার : নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, টানা ভারি বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, জুড়ী, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অসংখ্য বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে কমপক্ষে দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে একাধিক স্থানে নদী প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। উজানের পাহাড়ি ঢলে কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর, আদমপুর, মাধবপুর, কমলগঞ্জ, শমসেরনগর, রহিমপুর, পতনঊষা, মুন্সিবাজার ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে উপজেলার বেশিরভাগ সড়ক।
ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কমলগঞ্জ-আদমপুর আঞ্চলিক সড়কের ঘোড়ামারা ও ভানুবিল মাঝেরগাঁও এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। আদমপুর ইউনিয়নের ঘোড়ামারা, রানিরবাজার, ইসলামপুর ইউনিয়নের মোকাবিল ও কুরমা চেকপোস্ট এলাকায় নদীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে এবং পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। আদমপুর-ইসলামপুর সড়কের হেরেঙ্গা বাজার, শ্রীপুর ও ভান্ডারিগাঁও এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
কয়েক দিনের টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল এবং উজান থেকে নেমে আসা পানিতে জেলার সবকটি নদ-নদীতে পানি বাড়ছে বলে জানিয়েছে মৌলভীবাজারের পাউবো। সংশ্লিষ্টরা জানান, টানা বর্ষণে মনু ও ধলাই নদীর অন্তত ৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের সহ¯্রাাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে জুড়ী উপজেলার ফুলতলা, গোয়াবাড়ি ও সাগরনাল ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম। ৪০ হেক্টরের বেশি আমন ধান ডুবে গেছে। রাজনগর উপজেলার মনু নদীর উজিরপুর, একামধু ও কান্দিরকুল এলাকায় বাঁধ ভেঙে টেংরা ও কামারচাক ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মনু নদী (রেলওয়ে ব্রিজ) বিপদসীমার ১০৫ সে.মি, চাঁদনীঘাট এলাকায় ৭০ সে.মি, ধলাই নদীতে ৮ সে.মি ও জুড়ী নদীতে বিপদসীমার ১৭৪ সে.মি উপর দিয়ে এবং কুশিয়ারা নদীর পানি ২ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত লোকজন বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন মাঠে না থাকায় বিগত বন্যার মতো তারা সহযোগিতা পাচ্ছেন না। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারছেন না।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল বলেন, ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে আটটি স্থানে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। মনু নদীর বাঁধও ভেঙে গেছে। ভারতের ত্রিপুরায় বৃষ্টি হওয়াতে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টি কমে গেলে পানি নেমে যাবে। এ ছাড়া, যেসব স্থানে বাঁধ ভেঙেছে সেগুলোতে কাজ চলছে বলে তিনি জানান।
কুলাউড়া : কুলাউড়া অফিস জানায়, টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মনু নদীর পানি গতকাল বুধবার সকালে বিপদ সীমার ৭৫ সে: মি: উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওযায় উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নে রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাজীপুর গ্রামটি সর্ম্পূণরূপে প্লাবিত হয়েছে। ফলে, গ্রামের ৪’শ পরিবার স্থানীয় একটি স্কুলে ও রক্ষা বাঁেধ আশ্রয় নিয়েছে।
টিলাগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া, তাজপুর, লালবাগ ও খন্দকারের গ্রামের রক্ষাবাঁধ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। যে কোন মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবল বেগে প্রবেশ করতে পারে। গ্রামবাসী বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন। তিনি আরো জানান, কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন গতকাল বুধবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শন করে বন্যা কবলিতদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৪ মে: টন চাল ও শুকনো খাবার বরাদ্দ করেছেন। ভারি বর্ষণের ফলে কুলাউড়া পৌরসভার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কুলাউড়া-রবিরবাজার সড়কে একটি বেইলি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
মাধবপুর : মাধবপুর (হবিগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, মাধবপুরে গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সোনাই নদীর তীরবর্তী এলাকা পাড় উপচে পানি ঢুকে রোপা আমন, আবাদ করা সবজিসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া, ভাটি এলাকার মৎস্য খামার পানিতে ডুবে যাওয়ায় খামারের মাছ ভেসে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে মাধবপুরে থেমে থেমে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তÍু গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার পর্যন্ত অবিরাম ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা থেকে বয়ে চলা সোনাই নদীতে ব্যাপক পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সোনাই নদীর পানি কুটানিয়া, দীঘিরপাড়, সুলতানপুর এলাকায় তীর উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে রোপা আমন, সবজি ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে। ফলে মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। আন্দিউড়া গ্রামের ইউপি সদস্য আফজাল চৌধুরী জানান, গত দুই তিন দিনের বৃষ্টিতে সোনাই নদীর পাড় উপচে আন্দিউড়া, হাড়িয়া, মীরনগর, জগদীশপুর, বড়ধলিয়া কুটানিয়া, দীঘিরপাড়, সুলতানপুর মুরাদপুর বারচান্দুরা গ্রামে পানি ঢুকে রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শত শত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবু আসাদ ফরিদুল হক জানান, ভারি বর্ষণে অনেক মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। মৎস্য চাষিরা মাছ রক্ষার চেষ্টা করছেন। উপজেলা দুর্যোগ কর্মকর্তা নুর মামুন জানান,অবিরাম বর্ষণে অনেকের কাঁচা ঘরবাড়ি মাটিতে ধসে পড়েছে। রাস্তাঘাটের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সুরমা ও জগদীশপুর ও নোয়াপাড়া চা বাগানের ভেতর বালু উঠে চা গাছের ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। মাধবপুরের সহকারী কমিশনার রাহাত বিন কতুব জানান, সরেজমিনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ চলছে।