পরোপকারেই তিনি ছিলেন তৃপ্ত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ৭:৪৫:৫৭ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী :
জীবনে মহান মানুষ যারা, স্মরণীয় মানুষ যারা তাদের যে স্মরণ মনন, সেটা আমরা অনুসরণ করি তাদের জীবনের সায়াহ্নে, সপ্তর্ষিবর্ষ পূর্তিতে অথবা আশি বছর পূর্তিতে, কখনও বা শতবর্ষ পূর্তিতে। তার পরের ধাপটা হচ্ছে একশত পঁিচশ কিংবা তারপরে সার্বশতবর্ষে। ব্যতিক্রম ছাড়া মধ্যখানের এই কোয়ান্টাম স্টেপগুলোতে তাঁদের স্মরণ করিনা। এটি প্রায় জাতিগত নিয়মের অধীন।
হ্যাঁ ব্যতিক্রম কিছু যে নেই তা বলব না। আছে আমাদের বেলায়ও। ২০০৭ সাল হতে প্রতি বছর ১২ ডিসেম্বর আমরা শিক্ষা প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ, আত্মত্যাগী সমাজসেবী, রাবেয়া খাতুন চৌধুরীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি,
তার রুহের মাগফেরাত কামনা করি, শত হস্ত তুলে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করি, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।
শিরিশ কুসুমের পরাগের মত কোমল হৃদয়ের অধিকারী রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর জন্ম সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায়। এমন সময় তার জন্ম যখন মুসলমান পরিবারে মেয়েদের স্কুল কলেজে পাঠিয়ে লেখাপড়া করাতে আগ্রহী ছিলেন না মা বাবারা। মেয়েদের অপ্রয়োজনে বাইরে যাওয়াতেও ছিল কড়াকড়ি। পর্দাপ্রথা মেনে চলতে হতো। এত সব বাধা অতিক্রম করে তিনি স্কুল, কলেজে পড়ালেখা করেছেন। কলেজে পড়াকালেই ১৯৬৩ সালে জনাব রাগিব আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। স্বামীর সান্নিধ্যে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেন নিজের মতই। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে রাগিব আলী আর রাবেয়া খাতুন চৌধুরী জুটির বন্ধন শক্ত হতে থাকে। একজন যেন চলতে পারতেন না অন্যজনকে বাদ দিয়ে। পাশাপাশি থাকতেন সব সময়। কোমল হৃদয়ের অধিকারী রাবেয়া খাতুন চেীধুরী রাগীব আলীকে ভালবাসতেন মনে প্রাণে তেমনি রাগীব আলীও ভালবাসতেন তার প্রিয় সহধর্মীনিকে। দাম্পত্য জীবনে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী স্ত্রী বা মা হিসাবে কেমন ছিলেন তাতো আর নূতন করে চর্বন করার প্রয়োজন নেই। তবে আমাদের এ সময়ের জন্য তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে চরিত্র বিচারে। তিনি সেবার অঙ্গনে প্রত্যক্ষ বিচরণ করেছেন, সেবা দান করার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেবা দান করেছেন বিভিন্নভাবে আর এজন্যইতো তার মৃত্যুর পর নামাজে জানাযার আগে ও পরে হাজারো কথার মালা ফুটলো উপস্থিত মানুষের মুখে। স্বর্গীয় এ পরিবেশে ক’জনের ভাগ্যে জোটে অন্তিম প্রশংসার বচন?
পুরুষ এবং নারী একে অপরের পরিপূরক। স্বামী এবং স্ত্রী তেমনি এক অভিন্ন সত্য। পুরুষ সফলতার সুখ দেখে আদর্শ স্ত্রীর মাধ্যমে আবার স্ত্রীর জীবনে গতিময়তা আসে স্বামীর সার্বিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতায়। এক্ষেত্রে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি রাগীব আলী এবং রাবেয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন তেমনি এক স্বর্গীয় জুটি। প্রায় ৪ দশক ধরে এ জুটি বেড়িয়ে চলেছেন দেশে বিদেশে শহরে বন্দরে, গ্রামে গঞ্জে। তাঁদের কখনো ক্লান্ত হতে দেখা যায়নি। তারা এভাবেই সর্বত্র ঘুরে ফিরে সেবা করেছেন সমাজ ও সমাজের মানুষের। রাবেয়া খাতুন চৌধুরী নানা গুনে গুণান্বিত নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী। ২০০৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোর ৫ টায় তারই প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান মালনীছড়া চা বাগানের কোম্পানি বাংলোয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রাবেয়া খাতুনের আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর সমাজের সকল স্তরের মানুষের ঢল নামে মালনীছড়া চা বাগানের বাংলোয়। শিল্পপতি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী সমাজকর্মী রাজনীতিবিদ সাধারণ মানুষ ছাত্রছাত্রীরা, এমনকি চা শিল্প শ্রমিকরাও তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে ভীড় জমান। মানুষের ভীড় সামাল দিতে নিরাপত্তা কর্মীদের কঠোর বেগ পেতে হয়। তিনি সত্যিই যে মহীয়সী নারী ছিলেন সে দিনের এ উপস্থিতিতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মাইক দিয়ে যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা হচ্ছিল আমার পাশেই দাড়ানো ক’জন ভদ্রমহিলা একে অন্যকে বলাবলি করছিলেন যে মহিলা সেবামূলক কাজে দিবারাত্রি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তিনি এমনিতেই জান্নাতবাসী হবেন, ইনশাল্লাহ। তাদের মুখ দিয়ে বলতে শুনলাম ‘‘ হে আল্লাহ তুমি এ মহীয়সী নারীকে ক্ষমা করে জান্নাতবাসী করো’’। বেগম রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন হাজারো মানুষ। দেশ বিদেশ থেকে সরকারী/ বেসরকারী সংস্থা ও সংগঠন পাঠিয়েছেন অসংখ্য শোকবার্তা। তাদের বক্তব্যে এসেছে এ মহীয়সী নারীর নানা গুনের কথা। তবে তার বড় পরচয় তিনি মানবদরদী আর এ পরিচয়েই তিনি বেশী পরিচিত।
রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর মরদেহ মালনীছড়া চা-বাগান থেকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় শাহজালাল (রহ:)’র মাজারে। সেখানে বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হয় প্রথম নামাজে জানাজা। এখান থেকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ী কামালবাজার নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও মানুষের ঢল নামে। তার সর্বশেষ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় মসজিদ সংলগ্ন খোলা মাঠে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে। নামাজে জানাযার পর তাঁকে দাফন করা হয় মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক গোরস্থানে। জানাযা শেষে দাফনের কাজ যখন চলছিল সে সময় মানুষের মুখে রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর নানা গুণ ও প্রশংসার কথা শুনা যায় বার, বার। কামালবাজার গোরস্থান চত্তরে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মুখী বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি স্ত্রী হিসাবে যেমন সফল, মানবদরদী হিসাবেও অনন্যা। সে জন্যই তিনি প্রকৃত মহীয়সী রমনীর প্রতিচ্ছবি ছিলেন আমরণ। তিনি সত্যিই ভাগ্যবতী মহিলা। অনন্ত যাত্রার সময় এত প্রশংসা ক’জনের ভাগ্যেই জুটে। এ ধরনের ত্যাগীও সফল মহিলা বর্তমান সমাজে খুব একটা দেখা যায় না। তিনি নিজে প্রতিটি কাজে ছিলেন আন্তরিক, সহজ সরল জীবন যাপনে ছিলেন অভ্যস্ত।
দাম্পত্য জীবনে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী স্ত্রী বা মা হিসাবে কেমন ছিলেন তাতো আর নূতন করে চর্বন করার প্রয়োজন নেই। তবে আমাদের এ সময়ের জন্য তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে চরিত্র বিচারে। তিনি সেবার অঙ্গনে প্রত্যক্ষ বিচরণ করেছেন, সেবা দান করার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেবা দান করেছেন বিভিন্নভাবে আর এজন্যই তার মৃত্যুর পর নামাজে জানাযার আগে ও পরে হাজারো কথার মালা ফুটলো উপস্থিত মানুষের মুখে। স্বর্গীয় এ পরিবেশে ক’জনের ভাগ্যে জোটে অন্তিম প্রশংসার বচন?
প্রগতির দিকে, এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কিন্তু সমাজে এত বিশৃংখল অবস্থা কেন? কেন এ সমাজ মহিলাদের সম্মান ও মর্যাদা দিতে কার্পন্য করে? এর উত্তর আমরা কেমন করে দিব? অন্যদিকে বলতে হয় সমাজসেবী রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর মত মহীয়সী মহিলার সংখ্যাই আর কত? তাদের মত চরিত্রও গুণে বিকাশমান নারীদের খুঁজে পাওয়া যায় কি? এখন আমরা প্রকৃত মানুষের কথার মূল্য দেইনা। আদর্শ ও নৈতিকতার প্রবক্তাদের এড়িয়ে চলি। আমাদের মধ্যে এখন লোক দেখানো মানসিকতা বিদ্যমান। আমরা যা বলি তা করিনা আবার যা করি তা বলিনা। আমাদের মধ্যে এখন লুকোচুরির মানসিকতা বিরাজ করছে। সন্তানের প্রতি এখন আমরা আদর্শ নই। পিতা ও মাতা হিসাবে সন্তানেরা এখন আমাদের কাছ থেকে আদর্শ খুঁজে পায় না। ষাট বছরের বৃদ্ধ এখনো মা-বাবাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে খেদমত করে আবার ষোল বছরের ছেলে মা-বাবাকে অপমান করে। কেন এ বিপরীতমুখী চিত্র? এর জবাবে বলা যায় আমরা যেমন সন্তান হিসাবে অথর্ব তেমনি বাবা-মা হিসাবেও সন্তানদের কাছে অনাকাংখিত। এ জন্যই বিপরীতমুখী এ মনোভাব।
আমরা সবাই জানি, আমাদের সবার জীবনে আছে দুঃখ আছে মৃত্যুÑতবুও চলিÑচলাই ধর্ম। কারণ, সংসারের ধর্ম হল গতি। যদিও আমাদের প্রিয় মানুষটির অনুপস্থিতির জন্য সাময়িকভাবে আমাদের জীবনের ছন্দে কিছুটা হলেও ভাঁটা পড়ে। ‘তীর বেঁধে পাখি আর গাইবে না গান/ভুলে গেছে জীবনের হাসি কলতান/হাসি ছিল গান ছিল সাথী ছিল সাথে/বুঝিনি তো তীর ছিল নিয়তির হাতে।’ নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে প্রিয়জনদের ছেড়ে আমাদেরকে চলে যেতে হয় কোনো এক অজ্ঞাতলোকে একা অভিসারে, যেখান থেকে ইহলোকে আর কোনোদিন ফেরা সম্ভব হয় না। শুধু থেকে যায় কিছু বেদনাময় স্মৃতি।
আজ মরহুমা রাবেয়া খাতুন চৌধুরীকে স্মরণ করতে বলতে ইচ্ছা হয়, মানস উদ্যানে আজ ফুটুক কুসুম/ বৃন্ত ছিড়ে পরাগ বা রেনুসহ/ পাপড়ি বৃন্তে পুংকেশ্বর/ সমুকুট পুষ্প যেন অর্পিতে পারি ঋষি/ তোমার উদ্দেশ্যে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।