পুরোপুরি শুল্ক পরিশোধ করা না হলে সাদিক, রনজিত-ময়েজের গাড়ি যাবে নিলামে ॥ ব্যারিস্টার সুমন এনেছেন সর্বোচ্চ দামের গাড়ি
সিলেটের সাবেক ৪ এমপির ‘গাড়িবিলাস’
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬:১৬:৩৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
ড. মোহাম্মদ সাদিক। বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় ১৫৩ আসনে নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ার বহুল আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সেই নির্বাচন কমিশনের সচিব। সদ্য বাতিল হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদের একজন সদস্য। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর দেশের যে ৫২ সংসদ সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির সুবিধা নিয়েছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। তার গাড়ীর আমদানি মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা।
কিন্তু, নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী সর্বসাকুল্যে তার বার্ষিক আয় ১৪ লাখ ১৫ হাজার ৪১০ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, তার কাছে কি এমন যাদুর কাটি ছিল যে তিনি এই আয়ে এত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেছেন। সংসদ সদস্য কোটায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় এডভোকেট রনজিত সরকার ও এডভোকেট ময়েজ উদ্দিন শরীফও গাড়ি আমদানি করেছেন। এই তিনজনের গাড়ি আটকে দিয়েছে শুল্ক বিভাগ। কারণ, জাতীয় সংসদ বাতিল হওয়ায় তারা আর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন না। এখন গাড়ি নিতে হলে পুরো শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। বর্তমানে প্রতিটি গাড়ির কর বাবদ শুল্ক পরিশোধ করলে ৮ থেকে ৯ কোটি টাকা দাম উঠবে।
এদিকে, জাতীয় সংসদ বাতিলের আগে ২০ জুন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন তার আমদানি করা গাড়ী খালাস করে নিয়ে গেছেন। শুল্কসহ এই গাড়ীর বর্তমান বাজার মূল্য ১২ কোটি টাকা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বাতিল হওয়া ‘ডামি’ সংসদের নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ¦ী প্রার্থীরা তাদের সম্পদের বিবরণী হলফনামায় উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন। হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ -৪ (সদর-বিশম্ভরপুর) আসন থেকে প্রথম বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীকে ড. সাদিক বিজয়ী হন। ইতোপূর্বে তিনি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) চেয়ারম্যান ছিলেন।
তার বার্ষিক মোট আয়ের পরিমাণ ১৪ লাখ ১৫ হাজার ৪১০ টাকা। এ হিসেবে তিনি প্রতি মাসে ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৫১ টাকা আয় করেন। তার মোট অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৭৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৭ টাকা এবং স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৫৬২ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ড. সাদিকের হোয়াটসঅ্যাপে কল দেয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সুনামগঞ্জ-১ (জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা) আসন থেকে এবার প্রথম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট রনজিত সরকার। সিলেটের বহুল আলোচিত কিলিং স্পট টিলাগড় গ্রুপ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রক রনজিতের বার্ষিক মোট আয়ের পরিমাণ ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৭২ হাজার ৫০০ টাকা তার মাসিক আয় হয়। অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৫ টাকা এবং স্থাবর সম্পদের পরিমাণ রয়েছে ১ লাখ টাকা মূল্যের ৫৭ দশমিক ৯৩ শতক জমি। সিলেটের অপরাধ জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক রনজিত সরকারের বছরে আয় ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কোন ক্যারিশমায় রনজিত এত বিলাসবহুল দামি গাড়ি আমদানি করেছেন- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে রনজিত তার নিজস্ব জগত থেকে বিপুল পরিমাণ এ অর্থ সংগ্রহ করেছেন কিনা-সেটিও তদন্তের দাবি তুলেছেন অনেকে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রনজিত সরকারের সেল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং -আজমিরীগঞ্জ) আসন থেকে এডভোকেট ময়েজ উদ্দিন শরীফও প্রথম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তার পিতা শরীফ উদ্দিন মাস্টার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ময়েজ উদ্দিন শরীফের বার্ষিক মোট আয় ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। মাস হিসেবে আয়ের পরিমাণ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তবে তার স্থাবর সম্পদের কথা হলফনামায় উল্লেখ করেননি। এতো কম আয় দিয়ে কোন অদৃশ্য যাদুর বলে তিনি বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি করেছেন সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
ময়েজ উদ্দিন শরীফের বক্তব্য জানতে চেয়ে তার সেল ফোনে কল দেয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা বিলাসবহুল একটি গাড়ির প্রকৃত দাম ১ থেকে দেড় কোটি টাকার মধ্যে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে এসব জনপ্রতিনিধি প্রতি গাড়িতে ৮২৬ দশমিক ৬ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতেন। সে ক্ষেত্রে তাদের এ সুবিধা দিতে গিয়ে সরকারকে প্রতি গাড়িতে রাজস্ব বাবদ হারাতে হতো অন্তত ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা। কিন্তু, ক্ষমতা না থাকায় এখন শুল্কমুক্ত সুবিধাটি আর পাবেন না তারা। সে ক্ষেত্রে ১ কোটি টাকার একটি গাড়ি খালাসে তাদের এখন গুণতে হবে অন্তত পাঁচ থেকে সাত গুণ বাড়তি টাকা। আর শুল্ক শোধ না করলে গাড়িগুলোও খালাস করতে পারবেন না তারা।
সাবেক সংসদ সদস্যদের আমদানি করা গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে, ল্যান্ড ক্রুজার, রেঞ্জ রোভার, টয়োটা জিপ, টয়োটা এলসি স্টেশন, মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের। এসব গাড়ির প্রতিটির বাজারমূল্য প্রায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। অথচ শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে এসব গাড়ি শুধু আমদানি মূল্যেই (প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা) এনেছিলেন তারা। আমদানিকারকগণ আর সংসদ সদস্য না থাকায় তাদের গাড়ি আটকে দিয়েছে কাস্টমস। যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুরোপুরি শুল্ক পরিশোধ করা হলেই কেবল গাড়ি খালাস করা হবে। অন্যথায় গাড়িগুলো প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রি করা হবে।
সূত্র বলছে, দ্বাদশ সংসদে হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসন থেকে প্রথম বারের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক এবার সবচেয়ে দামী গাড়িটি এনেছেন। কাস্টমসের শুল্কায়নের নথি অনুযায়ী, গাড়িটির আমদানি মূল্য দেখানো হয় ১ লাখ ১১ হাজার ডলার বা ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। কাস্টমস শুল্কায়ন মূল্য (যে দাম ধরে শুল্ক আরোপ করা হয়) নির্ধারণ করে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ ধরনের গাড়ির শুল্কহার ৮২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। এ হিসাবে শুল্ককর আসে ১০ কোটি টাকার বেশি।
জাপানের ক্রস কনটিনেন্ট করপোরেশন থেকে গাড়িটি আমদানি করা হয়। এটি ২০২৪ সালে তৈরি। সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি (সিসি বা ইঞ্জিনক্ষমতা) ৩ হাজার ৩৪৫।
ব্যারিস্টার সুমনের বার্ষিক মোট আয়ের পরিমাণ ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ হিসেবে তার মাসিক আয় ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা।
সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক একটি জাতীয় সংবাদপত্রকে বলেন, ‘শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকলেও ছয় লাখ টাকা অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিয়েছি। দ্বাদশ সংসদের মেয়াদের সময় গত ২০ জুন গাড়িটি খালাস করেছি। তবে এখনো নিবন্ধন করিনি। কারণ আমার পুরোনো গাড়িটি বিক্রির পর মালিকানা বদলের প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। আমি একটি গাড়িই রাখব।’
গাড়ি আমদানিকারক সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বারবিডা) শুল্কমুক্ত এই গাড়ি আমদানির বিষয়ে বেশ কয়েকবার সরাসরি প্রশ্নও তুলেছিল।
সংগঠনটির সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ ডন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনার সুযোগে এমপি-মন্ত্রীরা চার হাজার সিসির একটি গাড়িতে ৮২৬ শতাংশ শুল্ক মাফ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশের দেশ ভারতেও এত দামি গাড়ি জনপ্রতিনিধিরা চালান না। অথচ আমাদের জনপ্রতিনিধিদের এই সুবিধা দিতে গিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। আমরা সব সময় এর বিরুদ্ধে ছিলাম। তাদের মাইক্রোবাস বা আড়াই হাজার সিসির দিলেও চলে। কয়েকজন জনপ্রতিনিধি প্রত্যয়নপত্র এবং গাড়ি খালাস করেছেন। তাদের বিষয়ে কিছু করা যায় কি না-তা এনবিআরকে অবশ্যই ভাবা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।’
আর বিভিন্ন মহল থেকেও এর সমালোচনা করে বলা হচ্ছে, জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সেবায় নিয়োজিত হয়ে এসে কেনইবা এত দামি গাড়ি চালাতে হবে, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হবে।
জানা গেছে, ১৯৮৭ সালে এইচ এম এরশাদের শাসনামলে শুল্কমুক্ত গাড়ি সুবিধা চালু করা হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের ২৪ মে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে সে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি।