চোরাচালানের দায়ে বিএনপির দুই নেতা স্থায়ী বহিষ্কার
সিলেট সীমান্তে বন্ধ হচ্ছে না চিনি চোরাচালান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ৮:৪২:৩১ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী : সিলেটে চিনি চোরাচালান কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই বিপুল অর্থের ভারতীয় চোরাই চিনি ঢুকছে অবাধে। চিনি চোরাচালানে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি শাহপরান থানার ওসি মনির হোসেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
গত রোববার রাতে ওসমানীনগর থানা পুলিশ ২০৫ বস্তা চিনিসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারদের মধ্যে দু’জন বিএনপির নেতাও রয়েছেন। জব্দ করা হয় ১টি ট্রাক, ২টি নোহা মাইক্রোবাস ও ২টি মোটরসাইকেল।
এদিকে, বহুদিন ধরে চিনি চোরাচালানে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ জড়িত থাকলেও এবার বিএনপি নেতাদের নাম এসেছে। আর ওই চিনি ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সিলেট মহানগর বিএনপির ২৫নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সোলেমান হোসেন সুমন ও ২৬নং ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নানকে স্থায়ীভাবে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। চিনি চোরাচালানে জড়িত দুই বিএনপি নেতার ছবি গতকাল সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ভাইরাল হতে দেখা গেছে।
সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, চিনি চোরাচালানের ঘটনায় ইতোমধ্যে বিএনপির দুই ওয়ার্ড সভাপতিকে স্থায়ীভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপি সাধারণ মানুষের দল, এখানে অপরাধীর জায়গা নেই।
ঘটনার পরই তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এভাবে বিএনপির যে কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তার আর রক্ষা নেই।
আর সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) সাইফুল ইসলাম বলেন, শাহপরান বাইপাসসহ এসএমপি এলাকায় চিনি চোরাচালান ঠেকাতে পুলিশ নিয়মিত মাঠে কাজ করছে। শাহপরান থানার ওসি চিনি চোরাচালানে সম্পৃক্ত বলে বলা হলেও এর স্বপক্ষে কোনো ডকুমেন্টস পাওয়া যায়নি। তার এমনটি করার সুযোগ নেই। তবুও বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা হবে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
২০৫ বস্তা চিনিসহ ৬ জন গ্রেফতার
আমাদের ওসমানীনগর সংবাদদাতা কয়েস মিয়া জানান, রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের সাদিপুর সেতুর উপর ২০৫ বস্তা চিনি চোরাচালানসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে ওসমানীনগর থানা পুলিশ। চিনি ভর্তি ট্রাক ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের আটক করে পুলিশে খবর দেন। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে তাদেরকে গ্রেফতার করে চিনিসহ থানায় নিয়ে যায়। এ সময় চিনি ভর্তি ১টি বড় ট্রাক, ১টি নোহা গাড়ি, ১টি নোহা (ভক্সি) গাড়ি ও ২টি মোটরসাইকেল জব্দ করে পুলিশ। জব্দকৃত গাড়িগুলো হলো, চিনি ভর্তি ট্রাক ঢাকা মেট্রো-ট ২৪-৪৩৮৪, নোহা গাড়ি ঢাকা মেট্টো-চ-১৫-১৫২০, নোহা (ভক্সি) ঢাকা মেট্রো চ-৫১-৪৯৩৩, মোটরসাইকেল সিলেট মেট্রো-ল-১১-২৫৭৭, সিলেট মেট্রো-হ-১২-৯২৬২।
ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন-সিলেট মহানগর বিএনপির ২৫নং ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও দক্ষিণ সুরমার বারখোলার ৪৫ রূপালি আবাসিক এলাকার মৃত ছানা মিয়ার পুত্র মো. সোলেমান হোসেন সুমন (৪২) এবং ২৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ভার্থখলার সোনালী ২২ আবাসিক এলাকার মৃত দিলু মিয়ার ছেলে মো. আবদুল মান্নান (৪৩)। এছাড়া চিনি চোরাচালানের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন, সিলেট শাহপরান থানার বটেশ্বরের মলাইটিলার মৃত করম আলীর পুত্র মনির আহমদ (৩২), জৈন্তাপুরের বাঘের খালের মমতাজ আলীর পুত্র তোফায়েল আহমদ (২৬), একই এলাকার জালাল উদ্দিনের পুত্র মো. শাহীন আহমদ (২৫) ও গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর তৃতীয় খ-ের মঈন উদ্দিনের পুত্র নজরুল ইসলাম (৪২)।
এ ঘটনায় ওসমানীনগর থানায় গতকাল সোমবার পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ০৫ ও ০৬।
সূত্র জানায়, ছিনতাইয়ের ঘটনার মামলায় ৪ জনের নাম উল্লেখ করে ৮/১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে এবং চিনি চোরাচালানের ঘটনায় ৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের গতকাল আদালতে সোপর্দ করা হয়।
এবার বিএনপি নেতাদের নাম
সূত্র জানিয়েছে, ভারত থেকে অবৈধভাবে নিয়ে আসা চোরাই চিনির চালান (প্রায় দশ লাখ টাকা) মনির আহমদ ও তার সহযোগীরা গোয়াইনঘাট থেকে একটি ট্রাক ভাড়া করে (ঢাকা মেট্রো-ট ২৪-৪৩৮৪) হবিগঞ্জের মিরপুরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিল। ট্রাকের নিরাপত্তার জন্য সামনে ছিল একটি নোহা ভক্সি মাইক্রোবাস। এরই মধ্যে চন্ডিপুল এলাকা থেকে একটি নোহা গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে সিলেট মহানগর বিএনপির ২৫নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মো. সোলেমান হোসেন সুমন ও ২৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মান্নান ট্রাকটির পিছু নেয়। এক পর্যায়ে সাদিপুর সেতুর উপর চিনি ভর্তি ট্রাকের গতিরোধ করে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়। এ নিয়ে চোরাকারবারীদের সাথে ছিনতাইকারীদের তুমুল হট্টগোল ও হাতাহাতি শুরু হয়। স্থানীয় কয়েকশ’ লোক জড়ো হয়। তারা উভয়পক্ষকে আটক করে পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে তাদেরকে গ্রেফতার করে। এ সময় আরও কয়েকজন ছিনতাইকারী ও চোরাচালানীদের ব্যবহƒত অন্যান্য গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ওসমানীনগর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুজ্জামান (পিপিএম সেবা) বলেন, চিনি ভর্তি ট্রাক, দুটি মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেল জব্দ করার পাশাপাশি ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। অন্যদেরকে ধরতেও পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
দুই নেতাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করলো বিএনপি
অন্যদিকে, সিলেট মহানগরের ২৬নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান এবং ২৫নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মো. সোলেমান হোসেন সুমনের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা অমান্য করে চিনি চোরাচালানিতে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের দু’জনকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে গতকাল সোমবার তাদেরকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়।
রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সিলেট মহানগরের ২৬নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান এবং ২৫নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মো. সোলেমান হোসেন সুমন-কে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হলো।
প্রসঙ্গত, সিলেটের গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন চিনির চোরাচালান নিয়ে আসা হচ্ছে। গত ছয় মাসে অন্তত হাজার কোটি টাকার চিনি অবৈধভাবে নিয়ে আসা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আগে চিনি চোরাচালানের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও চিনি চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তীতে রাজনৈতিক হাত বদল হলেও চিনি চোরাচালান কিন্তু থেমে নেই। ভারতীয় চোরাই চিনির চোরাচালান অবাধে আসছে।