চতুর্থ প্রজন্মের যুগে সিলেট-লন্ডন সম্পর্ক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৯:৩২:০৪ অপরাহ্ন

ইসমাইল আলী :
বলা হয়ে থাকে যে, উত্তরপূর্বের মহানগরী সিলেট বাংলাদেশের লন্ডন। এমনকি আমার জন্মস্থান যে ছোট্ট গ্রামে, সেই গ্রামের প্রায় ২০০ জন মানুষ এখন ব্রিটিশ নাগরিক। লন্ডনের অভ্যন্তরীণ বরোগুলিতে, বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটসে বসবাসকারী বেশিরভাগেরই সুন্দর কিন্তু খালি বাড়ি এবং গ্রামের প্রায় অর্ধেক আবাদি কিন্তু পরিত্যক্ত জমি রয়েছে।
লন্ডনে তাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাবিধ আর্থসামাজিক সমস্যা থাকলেও দেশে আত্মীয়স্বজনদের সহায়তা করার পাশাপাশি তারা তাদের রেখে আসা গ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কয়েক বছর আগে আমার এলাকার সাংসদ লন্ডন সফরে আসলে তাঁর সাথে দেখা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার কাজ সম্পন্ন করার অনুরোধ জানালে তিনি বলেছিলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ‘লন্ডোনি’ (বাংলাদেশী ব্রিটিশদের জন্য একটি জনপ্রিয় শব্দ) সহায়তায় এটি নির্মিত হবে।
সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, প্রায় ৬,০০,০০০ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই এসেছেন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল : সিলেট থেকে। ১৯৫০-এর দশকে এই অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক লোকজন যুক্তরাজ্যে চলে আসেন এবং প্রায় ৭৫ বছরে তারা তাদের জন্মভূমিতে পরিবর্তন এনেছেন।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা তাদের নতুন আবাসস্থল যুক্তরাজ্যেও ভূমিকা রাখছেন। পেশাদার, কূটনীতিক এবং এমপি হিসেবে তারা এই দেশে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলির (প্রধানত সিলেটি) সাফল্যের গল্প সকলের জানা। এটি ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বার্ষিক ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন পাউন্ড যোগ করে এবং ১,৫০,০০০ লোককে কর্মসংস্থান করে। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রিন্স হ্যারির আমেরিকান বংশোদ্ভূত স্ত্রী মেগান মার্কেলের জানা উচিত যে, চিকেন টিক্কা মশলা ব্রিটেনের জাতীয় খাবার।
লন্ডন-সিলেট সংযোগ ঐতিহাসিকভাবে গভীর। ব্রিক লেন একটি ছোট সিলেট এবং সিলেটের অনেক কিছুই লন্ডনের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেক ব্রিটিশ স্কুল সিলেটি ভাষাকে একটি পৃথক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তবে, চতুর্থ প্রজন্মের ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা তাদের দাদা-দাদীর ফেলে আসা গ্রামকে আর নিজেদের নিরাপদ বাড়ি মনে করেন না। প্রথম প্রজন্ম- যারা তাদের প্রিয়জনকে পিছনে ফেলে এসেছিলেন- নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তা প্রযোজ্য নয়।এই বিচ্ছিন্নতার পরিণতি অনেককেই উদ্বিগ্ন করে।
সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০০৯) এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, লন্ডনবাসী পরিবার এবং বাংলাদেশের পরিবারগুলির মধ্যে আর্থিক সম্পর্ক ‘দ্রুত পরিবর্তিত’ হচ্ছে। ‘১৯৯৫ সালে পূর্ব লন্ডনের ২০% বাংলাদেশী পরিবার বাংলাদেশে টাকা পাঠাচ্ছিলেন যেখানে ৬০ এবং ৭০ এর দশকে ৮৫% তাদের সঞ্চয় দেশে পাঠাচ্ছিলেন।’ আজ এই অনুপাত ১০% এরও কম হতে পারে। ১৯৯০ এর দশকে লন্ডনি-সিলেটিদের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা খুব বেশি ছিল। ছেলেমেয়েরা বিয়ে করতে বাংলাদেশে যেত। এখন এমন কম শোনা যায়। বরং এই প্রজন্মের ব্রিটিশ সংস্কৃতির মধ্যে যুক্তরাজ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা বেশি।
এই মনোভাব পরিবর্তন স্পষ্টতই একটি অনিবার্য বাস্তবতা। ব্রিটেনের বিপুল সংখ্যক পরিবারের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি তাদের আত্মীয়স্বজনের প্রতি নিয়মিত আর্থিক প্রতিশ্রুতিকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। পারিবারিক পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার ফলে অভিবাসনের মাধ্যমে বিভক্ত পরিবারের (সিলেট-লন্ডনে বসবাসরত) সদস্যদের মধ্যে জমি এবং সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। উপরন্তু লন্ডন প্রবাসীদের জমি, বাড়ি এবং ব্যবসা দখল সিলেটে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা।
‘লন্ডন কি দরিদ্র হয়ে উঠছে?’ সম্প্রতি টেলিফোনে কথোপকথনের সময় আমার এক ভাগ্নে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম কেন, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, তার পরিচিত বেশিরভাগ লন্ডন প্রবাসী আজকাল তাদের বাংলাদেশি সম্পত্তি বিক্রি করার কথা বলছেন। ২০ বছর আগে, আমার ভাগ্নে যেমন স্মরণ করেছেন, ঠিক তার বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল।
রেমিট্যান্সের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এটা সত্য যে, গ্রামীণ পরিবেশে বেশিরভাগ অর্থ জমি কেনা এবং বিলাসবহুল প্রাসাদ নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে। তবে শহরেও লন্ডনিদের টাকা খুব একটা গঠনমূলক উন্নয়ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, এমন নজির কম। লন্ডনের নিউহ্যাম বরোর প্রাক্তন লেবার পার্টির কাউন্সিলর আইয়ুব করম আলী যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন : সিলেটের শাহজালালল উপশহর এলাকায় বড় বড় লন্ডনী বাড়িগুলি এবং সিলেট শহরের অনেক শপিং সেন্টারের উপরের তলাগুলি খালি পড়ে আছে।
তবুও, রেমিট্যান্সের প্রবাহ (প্রতি বছর গড়ে এক বিলিয়ন ডলার) কেবল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সিলেটের অনেক পরিবারের জন্য এটি তাদের জীবনরেখাও। দ্য ডেইলি স্টারের জন্য একটি লেখায়, সৈয়দ জয়ন আল-মাহমুদ যুক্তি দেন যে, রেমিট্যান্স ঢাকার পরে সিলেটকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী শহর করে তোলার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
তিনি আরও বলেন, ‘সিলেটে বৃহৎ শিল্পের সংখ্যা কম এবং অন্যান্য জেলার তুলনায় কৃষি উৎপাদনও কম। যেখানে অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা বছরে তিনটি ফসল উৎপাদন করেন, সেখানে সিলেটের বেশিরভাগ অঞ্চলে মাত্র একটি ফসল উৎপাদন করা হয়।’
এর ফলে, সিলেট এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য অনেক শহর- মৌলভীবাজার, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ এবং গোয়ালাবাজার- লন্ডন সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এবং রেমিট্যান্স বন্ধ হলে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর এবং ছাতক উপজেলার যারা একই লন্ডন সংযুক্ত জীবনধারা উপভোগ করছেন, তারাও এই কষ্ট অনুভব করবেন।
নীতিনির্ধারকদের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জরুরিভাবে বিবেচনা করা উচিত। সিলেটে (গ্যাস, পাথর এবং খনিজ পদার্থের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ) একটি প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন কেবল ব্রিটিশ বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলিকে আকৃষ্ট করতে পারে না, বরং এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকেও বদলে দিতে পারে। তাছাড়া, সিলেটে বিনিয়োগ প্রতিবেশী ভারতের সাথে ব্রিটিশ ব্যবসার জন্য বাণিজ্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
সম্ভবত উপরোক্ত বিষয়গুলি মাথায় রেখে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার লন্ডন-সিলেট সংযোগ অন্বেষণ এবং সিলেটের সাথে দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যখন তিনি বলেন, ‘আমরা যা কিছু এদেশে করি, ব্রিটিশ বাংলাদেশীরা তার অগ্রভাগে।’
৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক হারের সাথে, বাংলাদেশ (আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতে, ব্রিকের পর পরবর্তী ৯টি দেশের মধ্যে একটি- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন) একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য। এবং ব্রিটেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার, দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগকারী এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি গন্তব্য হওয়ায়, সর্বদা সর্বোচ্চ গুরুত্বের দেশ।
অবশেষে, উচ্চশিক্ষিত এবং উদ্যোক্তা ব্রিটিশ-সিলেটিদের চতুর্থ প্রজন্ম রেমিট্যান্স-নির্ভর অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তে তাদের পূর্বপুরুষদের ফেলে যাওয়া অঞ্চলে বিনিয়োগভিত্তিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। এজন্য ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি অপরিহার্য। দখলবাণিজ্য সম্মিলিতভাবে সকলের ক্ষতি করবে। আমি এমন অনেককেই জানি, যারা উপযুক্ত সুযোগ পেলে উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু বেড়ে উঠেছেন সিলেটে এমন একজন আত্মীয় সিলেট থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ম্যানচেস্টার-ভিত্তিক (টক) একটি সুগন্ধি উৎপাদনকারী কোম্পানি শুরু করেছেন।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী কলামিস্ট