সিলেটে বৃদ্ধাশ্রম নয়, চাই শিক্ষার আলো
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২:৫৬:৪৯ অপরাহ্ন

নূর আহমদ :
সড়কের পাশে বড় একটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটি নতুন লাগানো হয়েছে। হঠাৎ করে বেশ এই বড় সাইবোর্ডটি যার চোখেই পড়ছে, একটু বিষ্মিত হচ্ছেন। তাতে লেখা রয়েছে- ব্রিটিশ বাংলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠান ‘প্যারেন্টস কেয়ার’। বাংলায় যাকে বলে ‘বৃদ্ধাশ্রম’।
সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের চাতলীবন্দ গ্রামে এই বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে বিতর্ক পুরনো। পৃথিবীব্যাপী এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ বক্তব্য রয়েছে। কেউ বলছেন বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক ভালোবাসার আশ্রম। আবার কোন কোন দেশে প্রবীণরা স্বেচ্ছায় আশ্রমে যেতে চান। বাংলাদেশে এখনো বেশিরভাগ মানুষ বৃদ্ধাশ্রমকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। আর সিলেটের সচেতন মহল তো মনে করেন ‘বৃদ্ধাশ্রম’ এর জন্য প্রয়োজনই নাই।
এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। ২১ জানুয়ারি রাত ১টা। কলিং বেল বেজে উঠলো। গ্রিলের সামনে আসা মাত্রই দেখা গেল কিছু তরুণ। যারা সমাজ নিয়ে চিন্তা করে, রাজনীতি করে। দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে বসতেই লক্ষ করলাম তারা খুবই মর্মামহত। জানালো, আমাদের গ্রামে কারা বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলছে। ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছে বলে সাইনবোর্ড টানিয়েছে। কিন্তু গ্রামের মুরব্বি বা তরুণরা কিছুই জানেন না। বোর্ডে লেখা আছে ব্রিটিশ বাংলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর প্রতিষ্ঠান ‘প্যারেন্টস কেয়ার’। এই তরুণদের বক্তব্য- আমাদের তো বৃদ্ধাশ্রমের দরকার নেই। আমাদের প্রয়োজন শিক্ষার। গ্রামে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ এর বিষয়টি আমাদের পীড়া দিচ্ছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্রিটিশ বাংলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর ফেসবুক পেইজ ঘেঁটে পাওয়া গেল বিস্তর তথ্য।
জানা গেল, খসরুজ্জামান খসরু নামের এক বাঙালি কমিউনিটি নেতা বৃদ্ধাশ্রমের জন্য চাতলীবন্দ গ্রামে তার কেনা ভূমি দান করেছেন। তাতে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার লক্ষ্যে চলতি মাসে যুক্তরাজ্যের একটি হোটেলে ফান্ড রাইজিং করেছেন। ফেসবুক পেইজের বিভিন্ন টেলিভিশন রিপোর্ট দেখে আরো জানা গেল এই বৃদ্ধাশ্রমের জন্য ব্রিটিশ বাংলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এক দিনে ২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। তাদের টার্গেট কমিউনিটির কাছ থেকে ৫শ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করা। বাংলাদেশী টাকায় যা দাড়ায় প্রায় ৭/৮ কোটি টাকা। পুরো টাকা ব্যয় করা হবে এই বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণে। ফান্ড রাইজিং পর্বে দেখা গেছে উদ্যোক্তারা খুব গর্বের সাথে বলছেন ‘সিলেট অঞ্চলে আমরাই প্রথম বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলছি’।
সেই বক্তব্যের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন চাতলীবন্দ গ্রাম তথা আশপাশ এলাকার সচেতন মহল। তারা বলছেন, যদিও বৃদ্ধাশ্রম পশ্চিমা বিশ্বে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপকরণ, আমাদের দেশে তার বাস্তবতা ভিন্ন এবং এখনও ব্যক্তি থেকে পরিবারের গুরুত্ব বেশি। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থা এখনও অটুট। গ্রামাঞ্চলে একই হাড়িতে রান্না করে এক সঙ্গে ২০/২৫ মানুষের খাবার দাবার খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আর পিতামাতা পরিবারের প্রধান হিসেবে পরিবারের নিয়ন্ত্রক। একই সাথে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বচ্ছন্দের চেয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যের শান্তিটুকুর মূল্য আমাদের সিলেটিদের কাছে অনেক বেশি মনে করা হয়।
এলাকার সচেতন মানুষের ভাবনা এবং বাস্তবতা হচ্ছে সিলেটে ছেলে বা মেয়ে স্বাবলম্ব^ী হলেই পিতামাতাকে ত্যাগ করে নিজে একা একা চলবে বা পিতামাতাকে আলাদা রেখে নিজে আলাদা থাকবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। সন্তান সাবালক হলেই পিতামাতার দায়িত্ব যেমন শেষ হয় না, তেমনি পিতামাতা বৃদ্ধ হলে এবং কর্মহীন হলে, তার দেখাশোনা করার সামাজিক দায়ভার সন্তানকেই নিতে হয়। তাই পশ্চিমের ওল্ডহোম বা বৃদ্ধাশ্রম আমাদের জীবনধারায় অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেনি। যদিও দু’-একটি কেস প্রয়োজন বিবেচনায় ভিন্ন।
সচেতন মহল আরো একটি বিষয় মনে করেন ‘প্যারেন্টস কেয়ার’ বা ‘বৃদ্ধাশ্রম’ করার আগে সিলেটে একটি জরিপ চালানো দরকার ছিল। ছিন্নমুল মানুষের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় সিলেট নগরীর বাগবাড়ি এলাকায় আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে কতজন বাসিন্দা রয়েছেন, মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে উঠছে কিনা সেটা জানা দরকার ছিল। সিলেট অঞ্চলে সন্তানের শ্রদ্ধা ভালোবাসা বন্ধনের বাইরে কেমন বাবা-মা আছেন যারা আশ্রমে থাকতে চান বা সুযোগ পেলে সুবিধা নিবেন। এই বিষয়ে আলোকপাত করলে সিলেটে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গড়ে তোলার প্রয়োজনীতার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
সবশেষে এলাকার মানুষের প্রত্যাশার বিষয়টি নজরে নিয়ে আসা জরুরি বলে মনে করছি। চাতলীবন্দ গ্রামটি অনেকটা প্রদ্বীপের নিচে অন্ধকারের মত। চাতলীবন্দ ও মৌলাটিকর গ্রাম নিয়ে টুকেরবাজার ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড। দেশ স্বাধীনের পর এখনো এই ওয়ার্ডে সরকারি কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি। একজন প্রবাসীর দান করা ভূমিতে দীর্ঘ দিন থেকে ‘এ কে এম আব্দুল মজিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। তবে শিক্ষকদের বেতন ভাতার অভাবে বিদ্যালয়টা এগুতে পারছে না। গ্রামে ‘বাবউল ইহসান’ নামে একটি বেসরকারি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হলেও সেটির অবস্থা আরো করুণ। বেতন ভাতার জন্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, ব্রিটিশ বাংলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারে। পুরো ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিক নেই, ভূমি দান করলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে উঠতে পারে। এলাবাসী মনে করেন, ব্রিটিশ বাংলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নিজস্ব ভূমিতে বৃদ্ধাশ্রম করছে। এলাকাবাসীর অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু বাঁধা দেয়ার এখতিয়ার নেই। তবে এলাকার তরুণদের প্রত্যাশা, ‘বৃদ্ধাশ্রমের জন্য প্রস্তাবিত ভবনে গড়ে উঠেবে অন্যান্য সেবা কার্যক্রম। যেখানে মানুষ সেবা নিবে। আর বৃদ্ধাশ্রম থাকবে শুন্য। বাবা-মা আত্মীয় স্বজনদের বন্ধন থাকবে অতীতের মতো দৃঢ়। পরিবারই হবে শেষ ঠিকানা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও চাতলীবন্দ গ্রামের বাসিন্দা।