শিশুসংগঠক হোসনে আরা আহমদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২:০৪:৫৮ অপরাহ্ন

নবেরা আখতার :
বেগম হোসনে আরা আহমদ একজন শিশু সংগঠকের নাম। একজন প্রগতিশীল নারীর নাম। যার মনন জুড়ে ছিল শিশুরা। শিশুদের জন্য যিনি কাজ করছেন দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে। যার হাত ধরে শুরু হয়েছিল সিলেট শিশু একাডেমির কার্যক্রম। যিনি ছিলেন সিলেট প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলার পরিচালক। প্রান্তিকের প্রাণ। বৃহত্তর সিলেটের শিশুদের প্রতিভা বিকাশে যিনি কাজ করেছেন নিরলসভাবে, পরিশ্রম করেছেন শিশুদের সুপ্ত প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করার লক্ষ্যে, খুঁজে বের করেছেন প্রতিভাবানদের। অসীম ভালোবাসা আর সকল স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে কাজ করেছেন অবিরত।
শিশু সংগঠক হিসেবে কাজ শুরুর আগে কাজ করেছেন সিলেট মহিলা পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সিলেটের পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন নিবিড়ভাবে। রক্ষণশীল সিলেটের অনেক তরুণীকে সাথে নিয়ে কাজ করেছেন সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে। সেই তরুণীদের ‘প্রিয় রুনু আপা’ ছিলেন তাঁদের সকল সেবামূলক কাজের সাথী।
১৯৭৬ সালে শিশু প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। প্রাথমিকভাবে ঢাকাসহ ২০টি জেলায় শিশু একাডেমির কার্যক্রম শুরু হয়। সিলেট জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব ফয়েজউল্লাহ সাহেবের অনুরোধক্রমে বেগম হোসনে আরা আহমদ অবৈতনিক সম্পাদক হিসেবে সিলেট শিশু একাডেমির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদিকে আবার কেন্দ্রিয় কচিকাঁচার মেলার অঙ্গ সংগঠন সিলেট প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলা তখন সিলেটে শিশুদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে। সিলেটের বেশ ক’জন প্রগতিশীল নারীকে প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলা তাদের উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। হোসনে আরা আহমদও সেই দলে ছিলেন। প্রান্তিকের তখন কোন অফিস ছিল না। হোসনে আরা আহমদ নিজ বাসার দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি ঘর প্রান্তিকের অফিসের ব্যবহার করার জন্য ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া বাসার বড় উঠানে প্রতিদিন বিকেলে প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলার শিশুরা যাতে শরীরচর্চা সহ নানা ধরনের খেলাধূলা করতে পারে তার ব্যবস্থাও করেছিলেন। অফিস কক্ষগুলোতে চিত্রাংকন, গান ও নাচ শেখার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
পাড়া প্রতিবেশী, আতœীয়স্বজন কিংবা সংস্কৃতি কর্মকান্ডে উৎসাহী পরিচিতজনের বাসায় বাসায় ছুটেছেন দিনের পর দিন, উৎসাহিত করেছেন তাদের শিশুদের প্রান্তিকের সদস্য ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসে। শনিবার ও রবিবারে গান, নাচ ও চিত্রাংকন প্রশিক্ষণ ক্লাস চলত। যেদিন শিশুদের সংখ্যা বেশি হতো, সেদিন নিজ বাসার একটি কক্ষে শিশুদের ক্লাস করার আযোজন করতেন।
এসব কাজ করার সময়ই সিলেট শিশু একাডেমির সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুরু করেন বৃহত্তর সিলেটের শিশুদের প্রতিভা বিকাশে কাজ। সেই লক্ষ্যে ছুটে বেড়াতেন সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে। জাতীয় শিশু পুরষ্কার প্রতিযোগিতা, নতুন কুঁড়িসহ জাতীয় পর্যায়ে বৃহত্তর সিলেটের শিশুদের অংশগ্রহণের লক্ষ্যে উৎসাহী শিশুদের খুঁজে বের করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। তৎকালীন সময়ে সিলেট স্কাউট ভবনের একটা কক্ষ শিশু একাডেমির অফিস কক্ষ হিসেবে সরকার থেকে বরাদ্দ করা হয়। শিশু একাডেমির নানা অনুষ্ঠানের আগে শিশুদের পরিবেশনা যাতে মান সম্পন্ন হয় তার জন্য পনের দিন বা সপ্তাহ ব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কক্ষ না থাকার কারনে নিজ বাসা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে উৎসাহী নিজের কোন আতœীয় বা বন্ধু বা পরিচিত জনের বাসায় প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতেন। ঢাকা ও সিলেটের স্বনামধন্য নৃত্য, গান, ছবি আঁকার শিক্ষকবৃন্দদের সাহায্যে প্রশিক্ষণ ক্লাস পরিচালনা করাতেন। খেলাধুলায় যাতে সিলেটের ছেলে শিশুদের পাশাপাশি কন্যা শিশুরাও সাফল্য নিয়ে আসতে পারে তার জন্য সিলেট ক্রীড়া সংস্থার সাহায্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। এসব কাজে উনাকে সবচেয়ে বেশি যারা সাহায্য করতেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিশু সংগঠক শ্রদ্ধেয় বেগম সুরাইয়া রাজা চৌধুরী এবং ব্লুবার্ড স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ বেগম সাজেদা চৌধুরী। বেগম হোসনে আরা আহমদ গাড়ি চালাতে পারতেন। নিজ গাড়ি চালিয়ে এই দুই মহীয়সী নারীকে নিয়ে ছুটতেন অভিভাবকদের কাছে বিশেষ করে কন্যা শিশু শিল্পীদের বাসায়। রক্ষণশীল সিলেটের অভিভাবকদের শর্ত ছিল, ‘আপনি নিজে যেখানে যাবেন আমাদের বাচ্চাদের সেখানে পাঠাব’।
কঠিন এই দায়িত্ব নিয়ে নিতেন অবলীলায়। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের নানা অনুষ্ঠানে শিশু শিল্পীদের নিয়ে যাওয়া, থাকা, ফিরে আসার সব দায়িত্ব পালন করতেন। সিলেটে অনুষ্ঠান হলে কখনো কখনো কন্যা শিশু শিল্পীদের বাসায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও পালন করতেন। সিলেটের বাইরে শিশুরা অনুষ্ঠান করতে গেলে তাদের থাকা, খাওয়া এমনকি চলাফেরাও যাতে নিরাপদ হয় সেদিকেও নজর রাখতেন তীক্ষ্ণভাবে।
শ্রদ্ধেয় নীনা চৌধুরী ছিলেন সিলেটের আরেক সমাজসেবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যিনি ছিলেন হোসনে আরা আহমদের এই কঠিন পথ চলার আরেক অবিচ্ছেদ্য সংগী। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবার দাবারের বিষয়টি যাতে সুষ্ঠু ও নিরাপদ হয় সে জন্য হোসনে আরা আহমদ সব সময় দায়িত্ব অর্পন করতেন নীনা চৌধুরীর উপর। যিনি তার আপন দক্ষতায় সেই দায়িত্ব পালনে ছিলেন অননন্য। পান্না চৌধুরী ও আবেদা চৌধুরীও ছিলেন শিশু এবং শিশু সংগঠকদের প্রিয় দুই খালাম্মা। হোসনে আরা আহমদসহ এঁনারা সবাই একসাথে কাজ করেছেন সিলেটের শিশু ও নারী শিল্পীদের প্রতিভা প্রস্ফুটনে।
প্রায় ৪ বছর সিলেট শিশু একাডেমির দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় সিলেটের শিশু শিল্পীদের জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে পুরস্কার প্রাপ্তিতেও উপরের দিকে অবস্থান ছিল উল্লেখ করার মত। তৎকালীন সময়ে সিলেটের শিশু শিল্পীদের সাফল্য গাঁথা ছিল সর্বমহলে বহুল প্রশংসিত।
১৯৭৯ সালে বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে সিলেট শিশু একাডেমি সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের শিশুদের নিয়ে আয়োজন করে শিশু উৎসবের। এতে চার জেলার সকল স্কুল এবং নানা সংগঠনের শিশুরা অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানটি সিলেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান সাহেব এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের দিন সারা সিলেট শহর শিশুদের পদচারণায় মুখরিত ছিল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। বেগম হোসনে আরা আহমদের নেতৃত্বে সিলেটের স্কাউট, গার্লস গাইড, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ, নানা শিশু সংগঠনের কর্মী ভাই বোনেরাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ প্রাণপণ পরিশ্রম করে বিশ্ব শিশু দিবসের এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যের চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।
একই বছর (১৯৭৯ সাল) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দুই দিন ব্যাপী সারা বাংলাদেশের শিশুদের সমাবেশ। যেটি ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে বৃহত্তর সিলেট থেকে ৮০ জন শিশু অংশগ্রহণ করে। অবাক হওয়ার বিষয় ছিল এই সমাবেশে বৃহত্তর সিলেটের ৮০ জন শিশুর মধ্যে অর্ধেক ছিল কন্যা শিশু। সুরাইয়া রাজা চৌধুরী, নীনা চৌধুরী এবং বেগম হোসনে আরা আহমদের নেতৃত্বে এই শিশুদের দল প্রায় ৫ দিন ঢাকায় অবস্থান করেছিল। ধানমন্ডি বালক ও বালিকা বিদ্যালয়ে শিশুদের থাকা ও খাওযার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মরহুম রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান সেই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও সিলেটের শিশুদের অংশগ্রহণ ও পরিবেশনা ছিল অসাধারণ।
বেগম হোসনে আরা আহমদ সিলেট শিশু একাডেমির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে মাহবুব আহসান চৌধরী (বাবর), আব্দুল কাইয়ুম লাহি, মোঃ নুরুল করিম খালেদ, আব্দুল মুকিত, ফারুক আহমদ, ইকবাল কবিরসহ বেশ কয়েকজন শিশু সংগঠকের সহযোগিতা ছিল নজর কাড়ার মত। যারা তাদের খালাম্মাকে নিঃস্বার্থ সাহায্য করেছেন দিনের পর দিন। নজরুল ইসলাম বাসন, শমসের আলী বাবলু, জহির খান লায়েক, মহিউদ্দিন শিরু, নুরুজ্জমান মনি, হামিদ মোহাম্মদ, শুভেন্দু ইমাম কিংবা বেলায়েত হোসেন রিপন- যাদেরকেই কোন অনুষ্ঠানে সহযোগিতার জন্য আহবান করেছেন তারা নিঃস্বার্থভাবে সহায়তা করেছেন তাঁদের আপা বা খালাম্মা হোসনে আরা আহমদকে।
শিশু একাডেমি প্রত্যেক জেলায় জেলা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া শুরু করলে বেগম হোসনে আরা আহমদ সিলেট শিশু একাডেমি থেকে বিদায় নেন। শুরু করেন আবার প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলা নিয়ে কাজ। প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলার এই যাত্রাতে হোসনে আরা আহমদকে করা হয় প্রান্তিকের পরিচালক। সিলেট শিশু একাডেমি সিলেট অডিটোরিয়ামে অফিস বরাদ্দ পেলে স্কাউট ভবনের কক্ষটি প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলাকে বরাদ্দ করেন স্থানীয় প্রশাসন।
সিলেটের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বেগম ফাতেমা চৌধরী (পারু) তখন জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য। তিনি ছিলেন প্রান্তিকের অন্যতম উপদেষ্টা। প্রান্তিকের এই উপদেষ্টা স্কাউটের অব্যবহৃত কক্ষগুলো শিশুদের প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহার করার নিমিত্তে প্রশাসন ও সরকারের নানা পর্যায়ে অপরিসীম ছুটাছিটি করে অনুমতি গ্রহণ করেন।
বেগম হোসনে আরা আহমদ এবং অন্য উপদেষ্টাদের নেতৃত্বে প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলা জেগে উঠে নবরূপে নব উদ্যমে। একদল তরুণ কর্মী বাহিনী নিয়ে হোসনে আরা আহমদ প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলার মাধ্যমে সিলেটের শিশুদের প্রতিভা বিকাশে কাজ করে গেছেন দিনের পর দিন। ছবি আঁকা, যন্ত্র সংগীত, গান ও নাচের ক্লাসের প্রশিক্ষণ ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলার নাম। বাংলাদেশ টেলিভিশিনসহ দেশে বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিশুদের পরিবেশনা ছিল নিয়মিত। প্রান্তিকের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনের নানা কার্যক্রমে বেগম হোসনে আরা আহমদের সাহায্যের হাত প্রসারিত ছিল সব সময়। সিলেট শিল্পকলা একাডেমির অনুরোধক্রমে সিলেট ও ঢাকায় নানা অনুষ্ঠানে প্রান্তিকের শিল্পীদের পরিবেশনা ছিল নিয়মিত। সিলেটের কোন নারী শিল্পীর পরিবারের বাসা থেকে মঞ্চ অনুষ্ঠানে পরিবেশনার ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ থাকলে বেগম হোসনে আরা আহমদ ও বেগম সুরাইয়া রাজা চৌধুরীর সাহায্য নিতেন সিলেট শিল্প একাডেমির তৎকালীন সময়ের সংগঠকরা (শ্রদ্ধেয় কয়েস সামি ও শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক বাহাউদ্দীন জাকারিয়া)। নিজে যেতেন সেই শিল্পীর অভিভাবকদের কাছে। আর সিলেটরে মানুষ শুনতে পেতেন একজন প্রতিভাময়ী নারী শিল্পীর পরিবেশনা।
সিলেটের রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ কিংবা শিখর কবিতা আবৃত্তি পরিষদ নিয়মিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন প্রান্তিকের মিলনায়ত কক্ষে। শুধুমাত্র কক্ষ দিয়ে শেষ নয়, এসব সংগঠনের যেকোন প্রয়োজনে প্রান্তিকের লোকবল নিয়ে সহায়তা ছিল অবধারিত। সিলেটের নাট্য সংগঠন নাট্যাঙ্গনের মহড়া কক্ষ নেই। একদল নাট্যকর্মী প্রান্তিকের অফিস কক্ষে সন্ধ্যার পর তাদের নাটক মহড়া দেয়ার অনুমতি চাইলেন। অনুমতি পেলেন, কিন্তু বাদ সাধলেন স্কাউট কর্তৃপক্ষ। অজুহাত সন্ধ্যার পর প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলার অনুষ্ঠান ছাড়া আর কারো কিছু করার অনুমতি নেই। প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে ছোটাছুটি করে নাট্যকর্মীদের অনুশীলনের ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করলেন শুধুমাত্র সিলেটের ছেলেমেয়েরা যাতে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে এগিয়ে যেতে পারে অনেক দূর পর্যন্ত।
রিকাবীবাজার থেকে চৌহাট্টা পর্যন্ত এলাকা হয়ে উঠল সংস্কৃতির এক মহামিলনকেন্দ্র। বড় ছোট সব শিল্পীদের মিলন কেন্দ্র হয়ে উঠল প্রান্তিকের সেই প্রশিক্ষণ কক্ষগুলো, বারান্দা, সামনের মাঠ। বারান্দার সিঁড়িতে বসে হোসেেন আরা আহমদ সবার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতেন। আর শিশু সংগঠকরা নানা পরামর্শের জন্য ছুটে আসতেন প্রিয় খালাম্মার কাছে। বন্যা দুর্গতদের সাহায্যের জন্য কাজ করবে প্রান্তিক তাই সিলেটের নাট্য সংগঠন এবং সমাজ সেবায় নিযোজিত সংগঠন গুলোকে নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। দশর্নীর বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হলো। প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলার সদস্যদের নিয়ে সেই টাকা দিয়ে জিনিসপত্র কিনে ছুটলেন পানিবন্দি মানুষের কাছে। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানসহ নানা দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলা এবং অন্য শিশু সংগঠনগুলো একসাথে মিলে যাতে অনুষ্ঠান করে তার আয়োজন করতেন সবাইকে নিয়ে।
১৯৮৩ সালে প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলা তিনদিন ব্যাপী তাঁদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দেয়। ঢাকা থেকে দাদা ভাই রোকনুজ্জামান খান, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, হাসেম খান, রাহাত খানসহ সবাই আসলেন অতিথি হয়ে সিলেটে। এর আগে প্রায় মাস ব্যাপী দিনে রাতে কাজ করে প্রিয় খালাম্মা ও প্রান্তিকের কর্মী বাহিনীকে নিরলস সহায়তা করেছেন সিলেটের সকল শিশু সংগঠক ও নাট্যকর্মীরা। হোসনে আরা খালাম্মা ডেকেছেন চুপ করে থাকা যাবে না এই মন্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন সবাই। প্রান্তিকের বিশাল কর্মী বাহিনীর সাথে যারা একাত্ব হয়ে কাজ করেছেন তারা হলেন শাহ রফিক টিটু, শাহ সাদিক মিঠু, লিটন তাজ, আব্দুল করিম, শক্তিব্রত হালদার মানু, শামসুল বাছিত শেরো, শাহিন আহমেদ, হায়দার খান দিলু, বিশ্বরূপ দে পিকলু, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, চম্পক সরকার, বিভাস শ্যাম পুরকায়স্থ যাদন, জামাল বাবুলসহ তৎকালীন সময়ে সিলেটে নাট্য কর্মী ও শিশু সংগঠকরা।
তিন সন্তানের (ইশফাক আহমদ ডেনি, নবেরা আক্তার, সাকেরা কাজী) মা ছিলেন হোসনে আরা আহমদ। নিজের সংসারকেও আগলে রেখেছেন পরম মমতায়। পাশাপাশি আতœীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের। নিজ বাসায় নানা ধরনের ফল ও ফুলের গাছ লাগানো ও যতœ করা ছিল নিজের শখ বা হবি। বাসা ভর্তি ছিল সব ধরনের ফল গাছে।
প্রথমে শিশু একাডেমির সাধারণ সম্পাদক, এরপর দুই দফায় ১২ বছর প্রান্তিককে নেতৃত্বদানকারী হোসনে আরা আহমদ ছিলেন সৎ, নিরপেক্ষ ও প্রচন্ড ব্যক্তিত্বময় একজন নারী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলার প্রাক্তন সকল সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন, কারো প্রয়োজনে প্রাক্তন সকল সদস্যকে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলার প্রাক্তন সদস্যরা তাঁদের প্রিয় খালাম্মার নিয়মিত খোঁজ খবর নিতেন, উপদেশ, পরামর্শ গ্রহণ করতেন নিয়মিত। প্রান্তিক কচি কাঁচার মেলার সদস্য লিপি, নিলু, কবির, জগু, পাপ্পু, বাবুল, হারুন, জাহাঙ্গীর, সোমা, তাপস, শহিদ, কাজল, রিপা, ইভা, দানিয়া, সোহানা, তহুরা তান্নি, চিনু, বারেদা, গোবিন্দ, বুলবুল, সুলতানা, মনি, সুয়েব, রিতা, আবু সুফিয়ান, মুজিব, হাসিব, বাকী, তান্নি, সীমা, পাপড়ি, রুবিনা, মিতি, ইমি, ফারহানা মিঠু, সোনিয়া, চুমকি এসব নাম ও প্রান্তিকের স্মৃতি নিয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
২০১৯ সালের ১৪ মে ৭৭ বছর বয়সে বেগম হোসনে আরা আহমদ চলে যান না ফেরার দেশে। সিলেটের শিশুদের প্রতিভা বিকাশে যিনি কাজ করেছেন নিরলসভাবে সেই মহীয়সী নারী এবং তাঁর সাথে যারা কাজ করেছেন, সকলের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।