বোরো উৎসব : আমাদের এই জনপদে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৮:৪৬ অপরাহ্ন

সেলিম আউয়াল :
আমাদের হাওরগুলোতে এখন আনন্দের ধুম লেগেছে, চলছে বোরো ধান কাটার উৎসব। কাকডাকা সেই ভোর থেকে শুরু হয় ধানকাটা, চলে সন্ধ্যে তক। চারপাশে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। প্রচণ্ড পরিশ্রম আর ব্যস্ততায় দিন কাটছে কৃষক আর কিষানির। কতো কাজ- জমিতে ধান কাটা। সেই ধান বাড়িতে নিয়ে আসা। তারপর ধান মাড়ানি। আরো তো রয়ে গেলো ধান শুকানো। এতো ব্যস্ততা আর পরিশ্রমের পরেও কৃষকের মনে খেলে যাচ্ছে আনন্দের ঢেউ।
বোরো ধান কাটার মৌসুম নিয়ে কৃষকেরা থাকেন উৎকন্ঠিত। কখনো অনাবৃষ্টি অথবা খরায় পুড়ে ধান, নেমে আসে পাহাড়ি ঢল, অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় ফসল। এই বছর এখনো সেই ধরনের কিছু ঘটেনি। তাই কৃষকেরা আছেন মনের আনন্দে। এরপরও আছে উৎকন্ঠা। হয়তো ঋণ করে চাষের ব্যয় মিটিয়েছেন, এখন সেই ঋণ মেটাতে হবে। এজন্যে অনেক চাষি ধান ঘওে না তুলেই বিক্রি করে দিচ্ছেন কম দামে। ভালোয় ভালোয় ফসল তুলতে পারলে শোধ করতে পারবেন ঋণ। ধানের ফলন ভালো হয়েছে, এখন ভালো দামে বিক্রি করতে পারলেই হলো।
কষ্টের ফসল নষ্ট হলে কি যে কষ্ট- এটা সে-ই বুঝে, যে কৃষক সূর্যের তপ্ত দহনে পুড়ে ফলিয়েছে ফসল। ধানের চারা যখন তর তর করে বাড়ছিলো, তখন কৃষকেরা দু’ হাত তুলে দোয়া করতো ধানের বাড়ন্তির জন্যে। এই প্রার্থনা ধনী-গরীব, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল হাওরবাসী মানুষের।
সিলেট অঞ্চলের প্রধান ফসল বোরো ধান। বাংলাদেশের সাতটি প্রশাসনিক জেলার বিস্তৃত হাওর অঞ্চলে বোরো ধানের চাষ হয়। এই সাতটি জেলায় প্রায় ৭ লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জলাভূমি বিস্তৃত, যা সাধারণভাবে ভাটি অঞ্চল বা ভাটির দেশ হিসেবে পরিচিত। এই ভাটিঅঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলায় হাওরের সংখ্যা ৯৩৩টি, তারপর কিশোরগঞ্জে ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওরের অবস্থান। হাওর অঞ্চলসমুহ এক সময়ে গৌড়, লাউড়, তরপ, বানিয়াচং, ইটা ও জগন্নাথপুরের সামন্ত রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। আর এই হাওরগুলোতে বেড়ে ওঠে গবাদি পশু, প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে ওঠে মাছ। সারা দেশের মাছের চাহিদার ২০ ভাগ যোগান দেয় এই সাতটি হাওরকন্যা। দেশের শতকরা ১৮ ভাগ ধান উৎপাদিত হয় এই সাতটি জেলায়। এখানের কৃষি উৎপাদন ও মাছের পরিমান জনসংখ্যার অনুপাতে উদ্বৃত্ত। এজন্যে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ করা হয় দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে।
বোরো ধান কাটতে কাটতে অথবা কাটার পর আসবে বর্ষা। ভরা বর্ষা হচ্ছে হাওরের যৌবনকাল। চারপাশে পানি আর পানি। সেই পানিতে সাঁতার কাটে দামাল ছেলেরা মেয়েরা, পানিতে আনন্দের দাপাদাপি। হাওরের শান্ত জলে আপন মনে সাঁতার কাটে পানকৌড়ি, মাইলের পর মাইল পথ পেরিয়ে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমায় হাওরের বুকে। হাওরের শান্ত বাতাসে ভাটিয়ালি, জারি, সারি আর মুর্শিদি গানের টান সবাইকে পাগল করে তুলে। যদি ফসল নেয় বানে, আনন্দেও রশি ছিড়ে যায় বেদনার টানে। চারপাশের সার্বিক পরিস্থিতি কৃষকের মনে আশার মিনার গেড়েছে, এবার গোলায় উঠবে ফসল। কুটুমখেশকে উপহার দেবে নতুন জামা-কাপড়। কনেকে নাইওর নিয়ে আসবেন বাবা। বর্ষার জল যতো বাড়বে, কনের বাড়বে অস্থিরতাÑ কখন যাবে বাপের বাড়ি। একটা সময় তো ছিলো নানা কারণে হয়তো বাপের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না, তখন বাপের বাড়ির দিক থেকে আসা নৌকা দেখে দেখে চোখের জল ফেলতো কন্যা। কতো গান-গাঁথা এই নাইওরি নিয়ে।
হাওরবাসীর হাজার বছরের শান্ত-সমাহিত জীবনে আজ ধীরেধীওে প্রযুক্তি সম্পৃক্ত হয়েছে। ধানকাটার মৌসুমে সৃষ্টি হয় শ্রমিক সংকট। সিলেটের বাইরে থেকে ছুটে আসেন মেহনতি মানুষ। সব সময় পাওয়া যায় না মেহনতি মানুষের সন্ধান, এজন্যে কৃষি ক্ষেত্রে এখন বেড়েছে যন্ত্রের ব্যবহার। এক সময় যন্ত্রেও ব্যবহার ছিলো ধান ভাংতে। এখন হালচাষ, ধান কাটা-ধান মাড়াইসহ অনেক জায়গায় এসেছে যন্ত্র।
চৌদ্দশ বত্রিশ বাংলার বোরো নিয়ে অনেক আশা। কৃষি বিভাগ বলেছে চাষের জমির পরিমাণ বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় ফসলও উঠবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এগারো বোশেখ থেকে শুরু হবে বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান। সরকার সারা দেশ থেকে ১৪ লাখ টন চাল আর ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। এবার সিলেট বিভাগে ৩২ হাজার ৪৬৩ মেট্রিক টন বোরো ধান এবং ৫২ হাজার ১৪১ টন সিদ্ধ চাল ক্রয় করা হবে বলে খাদ্য অধিদপ্তর আশাবাদী। প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা এবং আতপ চাল ৪৪ টাকায় সংগ্রহ করা হবে। এইসব নিয়ে কৃষকেরা আশায় বেঁেধছেন বুক। কৃষকের মুখে ফুটুক হাসি, তাহলে সারা দেশের মানুষের মুখে ফুটবে হাসি।
সূত্র : বৈচিত্রময় হাওর, সম্পাদক: কারার মাহ্মুদুল হাসান ও রুহুল আমিন মাহমুদ, সাহিত্যকাল, পুরানাপল্টন, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত, প্রকাশকাল: ২০ অক্টোবর ২০১৯
লেখক : সাংবাদিক, গল্পকার।