বামপন্থীদের আশ্রয়দাতা ভাসানী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ৯:৫৪:২৬ অপরাহ্ন

নজরুল ইসলাম বাসন :
পূর্ব পাকিস্তানে বামপন্থীদের আশ্রয়দাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী। কট্টর বামপন্থী হিসাবে পরিচিত মোহাম্মদ তোয়াহা ও আন্ডারগ্রাউন্ড নেতা আব্দুল হক ছিলেন ভাসানী ন্যাপের সাথে। এছাড়াও কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো এর মত ছাত্র নেতারা মওলানা ভাসানীর ন্যাপের পতাকাতলে ছিলেন। ১৯৭১ সালে মওলানা মোজাফফর ন্যাপের সাইফুল ইসলামকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন। কলকাতায় তাকে পার্ক স্ট্রীটের কোহিনুর প্যালেসের ৫ তলায় ফ্ল্যাট দেয়া হয়। প্রবাসি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি হিসাবে মওলানা ভাসানীকে রাখা হয়। উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব তাজ উদ্দিন আহমদ, মনি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং মনোরঞ্জন ধর। মওলানা চীনের মাও সেতুং, ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্যে পত্র লিখেন। উল্লেখ্য যে মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে কাগমারি সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানকে সালাম জানিয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালের ১৮ই জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার দাবি জানান।
মওলানা ভাসানী সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত জীবনী গ্রন্থের ২৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ভাসানী সাহেব আমাকে চিঠি দিলেন ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকতে। মওলানা ভাসানীর খেলা বোঝা দায়। তারপরও আমি কনফারেন্স ডেকে চিঠি দিলাম যে মওলানা ভাসানী যেহেতু সভাপতি তাই তার নির্দেশমত ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করলাম। জনাব আবুল মনসুর আহমদ তখন ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের সভাপতি। সভার তিন চার দিন আগে মওলানা ভাসানী জানালেন তিনি ওয়ার্কিং কমিটির সভায় থাকবেন না। উপায়ান্তর না দেখে সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমান খোন্দকার ইলিয়াসকে নিয়ে মওলানা কে খুঁজতে বেরুলেন। তাদের কাছে খবর ছিল মওলানা বগুড়া জেলার পাচবিবিতে আছেন। বঙ্গবন্ধু জনাব খোন্দকার ইলিয়াসকে সাথে নিয়ে রওয়ানা দিলেন পাচবিবিতে। তারা যখন বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়ে ফুলছড়ি ঘাটে গেছেন তখন বগুড়া থেকে একটা ট্রেন এসেছিল। সেখানে সেকেন্ড ক্লাসের এক কামরায় মওলানা সাহেব বসা। বঙ্গবন্ধু আর খোন্দকার সাহেব তাকে পাকড়াও করলেন।
মওলানা সাহেব বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন বললেন তোমরা জান না তোমাদের নেতারা ঐক্যফ্রন্ট করার জন্যে পাগল হয়ে গেছে। আমি এসব নীতি ছাড়া নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো না। আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব। আমার তো কিছু নেই, আমি ইলেকশনও করবো না। কারও জন্যে ক্যানভাসও করব না।” এরপর তারা হাঁটতে হাঁটতে সর্দারের চর নামে এক গ্রামে মওলানার এক মুরিদের পর্ণ কুঠিরে আহার ও রাত্রি যাপন করলেন। সারারাত মওলানাকে বুঝিয়ে ময়মনসিংহের অলকা সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নেয়া হল। ঐ সভায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ও যুক্তফ্রন্ট করার ব্যাপারে আলোচনা সমালোচনা হয়। এই সভার পরেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তার অনুসারিদের নিয়ে গঠন করলেন কৃষক প্রজা পার্টি। এরপর পাকিস্তানের রাজনীতিতে হক ভাসানী সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক যাত্রা বিভিন্ন পথে যেতে শুরু করল। বাংলার রাজনীতিতে বিভেদ হল শুরু।
মওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে আপোষকামীতার কোন ছোয়া ছিল না, সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ধীরে চল কৌশলি নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমান যখন লন্ডনে ইস্ট পাকিস্তান হাউসের ছাত্রদের সাথে মিলিত হতেন তখন এসব প্রবাসি ছাত্রদের অনেকেই এই দুই নেতার সাথে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ইস্ট পাকিস্তান হাউসের ছাত্ররা জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনি প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন দাবি করছেন না কেন? এর উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের নেতা তিনি বেঁচে থাকতে আমি তা করতে পারবো না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলতেন পাকিস্তানের ঐক্য ধরে রেখেছি আমি আর পিআইএ (পাকিস্তান এয়ার লাইন্স)। মওলানা ভাসানীকেও এ ভাবে স্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন আমার সংগঠন এখন যে পর্যায়ে রয়েছে তা দিয়ে স্বাধীনতা আনা সম্ভব নয়। শেখ মুজিব এটা করতে পারে।” যুক্তরাজ্যে ন্যাপ গঠন সম্পর্কে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ১৯৬৩ সালে মওলানা ভাসানী গ্রেট বৃটেন ন্যাপ গঠন করলেও এই সংগঠন খুব সক্রিয় ছিল না। পরে মিসেস বারবারা হক ও সাংবাদিক আব্দুশ শাকুর ন্যাপ পুনর্গঠনে উদ্যোগী হন, ব্যারিস্টার আশিক আলী ও ব্যারিস্টার ফজলুল হক ও পরে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন।
১৯৬৬ সালের ৩-১০ জানুয়ারি কিউবার রাজধানী হাভানা পিপুলস সলিডারিটি সম্মেলন থেকে ফেরার পথে মওলানা ভাসানী নিজে ব্যারিস্টার ফজলুল হককে সভাপতি ও মিসেস বারবারা হককে সেক্রেটারি করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অব পাকিস্তান এর লন্ডন শাখা গঠন করে যান। পশ্চিম লন্ডনের গ্রেইস ইন রোডের ৩৭৪ নম্বরে ন্যাপের অফিসের ঠিকানা হয়। এরপর ন্যাপ এর ঠিকানা কয়েকবার বদল হয়, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পুত্র শফিকুল গনি স্বপন (পরে বিএনপি ও জাপার মন্ত্রি হয়েছিলেন।) ন্যাপের সাথে যুক্ত হন। এ ছাড়াও আরো অনেকে ন্যাপে যোগ দিলে গ্রেট বৃটেন ন্যাপ নামে আবির্ভূত হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা চীনপন্থী ছাত্রনেতা জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, লুৎফুর রহমান শাজাহান, মেসবাহ উদ্দিন, মোতাহার হোসেন ভূইয়া, আবু মুসা, সামসুল আলম, এম এ ওয়াদুদ, জামাল হোসেন ভূইয়া, আলী শহীদ খান, গোলাম সরওয়ার, জগলুল হোসেন, শাখাওয়াত হোসেন, শেলি চৌধুরী, জহিরুল হক, মইদুল ইসলাম, তাদের সংগঠন ছিল জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। ১৯৬৯ ১লা জুন জিয়া উদ্দিন মাহমুদ ও এম এ ওয়াদুদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ন্যাশনেল আওয়ামী পার্টি লন্ডন শাখা গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
অন্যদিকে ফজলুল হক ও সবুর চৌধুরির নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ এর অস্তিত্বও ছিল। ১৯৭১ সালের সময় বৃটেনের ভাসানীপন্থীদের ভূমিকা ছিল বিভ্রান্তিকর। হক তোয়াহার তত্ত্ব দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি এবং কলকাতায় মওলানা ভাসানীকে অভ্যন্তরীণ করে রাখা হয়েছে এসব ব্যাপার মওলানা ভাসানী সমর্থকদের মূলস্রোতে মিশতে দেয়নি। ভাসানী সমর্থকদের রাজনৈতিক মুখপত্র গণযুদ্ধ তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরতো। ১৯৭৪ সালের ১২ই অক্টোবর ভাসানী সমর্থকদের মুখপত্র আওয়াজ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় বলা হয় বাংলাদেশ ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল এই এক দশক যুক্তরাজ্যে ভাসানী ন্যাপের কার্যক্রম ও ভাসানী সমর্থকদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭৬ সালের ১৪ই আগস্ট চিকিৎসার জন্যে মওলানা ভাসানী লন্ডন আসেন, তখন ন্যাপকে পুনর্গঠনে উদ্যোগী হন সাংবাদিক ও পরবর্তীকালে ব্যারিস্টার আকবর আমিন বাবুল, আব্দুশ শহীদ, ডাঃ শামসুল আলম, মোহাম্মদ মোস্তফা, ফজলে লোহানি, সাইফুল ইসলাম রাব্বী প্রমুখ। ১লা নভেম্বর ডাঃ শামসুল আলমকে আহ্বায়ক ও এ জেড এম জোবায়দুর রহমানকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট যুক্তরাজ্য ন্যাপের কমিটি গঠন করা হয়। ১৯ই নভেম্বর ঢাকায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ইন্তেকাল করেন। ভাসানী ন্যাপের অনেক নেতা ও সমর্থক থাকলেও দেশের রাজনীতির তাত্ত্বিক কারণে যুক্তরাজ্যে ন্যাপ সংগঠিত হয়ে উঠেনি। বাংলাদেশে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ বিএনপিতে যুক্ত হলে লন্ডনের নেতারাও বিএনপিতে যোগ দেন।
লেখক : অতিথি সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক।