৪ মাস পর দেশে ফিরে নেতা-কর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত খালেদা জিয়া
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মে ২০২৫, ৫:২৭:৫৭ অপরাহ্ন

ডাক ডেস্ক : গানের ভাষাতেই বলতে হয় ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভিআইপি রোডের দুই পাশে সারিবদ্ধ বিএনপি নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের ঢল।
কারো হাতে বিএনপির স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড, কেউবা ব্যানার হাতে আর কাউকে উঁচিয়ে রাখতে দেখা গেছে দলের পতাকা।
চারদিকে যেন খুশির জোয়ার। আর জনসাধারণের এই স্রোত বয়ে গেছে গুলশানের ফিরোজা ভবন পর্যন্ত। যে কারণে সড়কে কিছুটা যানজট থাকলেও তার ভোগান্তি যেন কাল স্পর্শ করতে পারেনি সাধারণ মানুষকে। দল মত নির্বিশেষে সবার চোখে মুখে খুশির ছাপ দেখা গেছে।
আর এই খুশি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চার মাস পর চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসার খুশি। আর এই আনন্দে যেন প্রকৃতিও জোট বেঁধে শামিল হয়েছে। তাইতো আকাশ সেজেছে মেঘলা রূপে।
সকাল থেকে রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এই প্রতিবেদক। সকাল হওয়ার সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জাতীয়তাবাদী দলের নেতা-কর্মীরা দলে দলে রাজধানীর দিকে ছুটে আসেন প্রিয় নেত্রীকে দেশে ফিরে আসার অভ্যর্থনা জানাতে।
বেলা সোয়া ১১টায় বিমানবন্দর থেকে বেগম জিয়ার গাড়িবহর ফিরোজার উদ্দেশ্যে ধীর গতিতে চলছিল। সেই গাড়ি কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকা অতিক্রম করার সময় স্লোগানে মুখরিত হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। সাধারণত গাড়ির সামনে বসতে তেমন একটা দেখা যায়নি বেগম জিয়াকে। তবে গতকাল গাড়ির সামনের সিটেই বসেছিলেন তিনি।
অভ্যর্থনার আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছেন আসলাম শেখ। ৬০ বছর বয়সী বিএনপির এই কর্মী জানান, হাসিনা সরকারের ১৬ বছরে নিজ এলাকাতেই তিনি কখনও বিএনপির স্লোগান নিয়ে বের হতে পারেননি। আর তাই আজ এই জনসমুদ্রে চিৎকার দিয়ে বারবার বিএনপির স্লোগানে আসলামের সাথে দলের অন্যান্য কর্মীরা সেই আক্ষেপ পুষিয়ে নিচ্ছেন।
‘আমাদের নেত্রী বীর যোদ্ধা, তার বিরুদ্ধে এত মিথ্যা মামলার পরও তিনি হেরে যাননি, এমনকি দেশ ও দলের নেতা-কর্মীকে রেখে পালিয়েও যাননি। বরং বীরদর্পে সবকিছুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ তিনি বিজয়ের মুকুট পরেছেন,’ বলছিলেন রাজধানীর বাড্ডা থেকে আগত যুবদলের জুলহাস উদ্দিন।
বিএনপির পক্ষ থেকে আগে থেকেই নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ফুটপাতে অবস্থান নিতে, যাতে সড়কে ভিড় না হয় এবং যান চলাচল ব্যাহত না হয়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই নির্দেশনা নিশ্চিত করেন। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। তবে সাময়িক কিছু যানজটের সৃষ্টি হলেও তা ভোগান্তিতে রূপ নেয়নি। বরং গাড়িতে থাকা উৎসুক জনতাও বেগম জিয়াকে একপলক দেখার অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপরে সিএনজির গেট খুলে বাবা-মায়ের সাথে ৮ বছর বয়সী রাফসানও জানে আজ কে এলো দেশে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি দেখিয়ে দুই সন্তানকে চিনিয়েছি। আর আজ এমন সময় আমরা রাস্তায় বের হয়েছি তিনিও আসছেন, তাই ছোট ছেলেকে দেখানোর চেষ্টা করছি যতটুকু পারা যায়, বলছিলেন রাফসানের বাবা।
‘আমরাতো বিএনপির ইতিহাস কিছুটা হলেও জানি। কিন্তু আমাদের সন্তানরা কিন্তু এখনও বিএনপির সংগ্রামের অনেক কিছুই জানে না। তাদেরকে দীর্ঘ বছর ইতিহাসের অন্ধকারে রাখা হয়েছে,’ যুক্ত করেন তিনি।
গত ৭ জানুয়ারি জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। চিকিৎসা শেষে সোমবার রাতে কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে গতকাল দেশে এলেন তিনি। তার সঙ্গে এসেছেন দুই পুত্রবধ‚- তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি।
৭৯ বছর বয়সী এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস এবং আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতার শিকার। লন্ডনে গিয়ে লন্ডন ক্লিনিক নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। সেখানে তিনি ১৭ দিন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি এবং অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত¡াবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ২৫ জানুয়ারি থেকে তিনি তার বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন।
এরও আগে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের সময় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা। তবে মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন হয় পরে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। ২০১৮ সালে এই মামলায় তাকে দণ্ডিত করে কারাগারে পাঠানো হয় এবং পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে তার সাজা বৃদ্ধি করা হয়।
খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ছাড়ার বা দেশত্যাগের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু তিনি কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করেননি। ফলে তার কারাবরণ হয়ে ওঠে দেশে গণতন্ত্র সংকটের প্রতীকী প্রতিফলন। প্রায় তিন বছর কারাগারে কাটানোর পর, ২০২১ সালের মার্চে করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে সরকার নির্বাহী আদেশে তাকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেওয়া হয়।
তবে এরপর প্রায় চার বছর তিনি ছিলেন নানা শারীরিক জটিলতা এবং চিকিৎসাজনিত সীমাবদ্ধতায়। দেশে থেকেই চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়েছে তাকে। কারণ, তাকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের ঘোষণার মাধ্যমে তার মুক্তির পথ সুগম হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তার সাজা বাতিল হয় এবং উচ্চ আদালতের রায়ে তিনি খালাস পান। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। তার রাজকীয় প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন অনেকেই।