এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণকান্ড : দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দুটো মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২৫, ৩:৪৪:১৯ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের দুটো মামলার বিচার কার্যক্রম অবশেষে সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শুরু হচ্ছে। আজ মঙ্গলবার মামলার তারিখ ধার্য করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশের পর মামলার নথিপত্রও ইতোমধ্যে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এসেছে।
বাদী পক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী গতকাল সোমবার সিলেটের ডাককে এই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দুটো মামলার বিচার কার্যক্রম এক সাথে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করার জন্যে প্রথম থেকেই বাদী পক্ষ বলে আসছে। কিন্তু ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্ত করতে পদে পদে নানান প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল। এমনকি উচ্চ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে এ্যাটর্নী জেনারেলের অফিস থেকে আপীল দায়ের ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। শেষ পর্যন্ত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে একইসাথে দুটো মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
জানা গেছে, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মামলার নথিপত্র গত রোববার সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা গ্রহণ করেন। এরপরই ট্রাইব্যুনালে মামলার প্রথম তারিখ হিসেবে আজ মঙ্গলবার ধার্য করা হয়। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে বাদী পক্ষকেও জানানো হয়েছে। আজ থেকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শুরু হবে মামলা দুটোর বিচার কার্যক্রম।
গত ১৭ মার্চ সোমবার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ্যাটর্নী জেনারেল অফিস থেকে করা লিভ টু আপিল বাতিলের আদেশ দিয়ে মামলা দুটোর নথিপত্র ৩০ দিনের মধ্যে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের আদেশ দেন। এর আগে বর্তমান এ্যাটর্নী জেনারেল অফিস থেকে লিভ টু আপিল প্রত্যাহারের আবেদন করা হলে ওই দিন এবিষয়ে শুনানি শেষে উচ্চ আদালত ওই আদেশ দেন। উচ্চ আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে বহুল আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার বিচার কার্যক্রম অবশেষে শুরু হচ্ছে বলে বাদী পক্ষের আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়,২০২৩ সালের জুন মাসে নজিরবিহীনভাবে তৎকালীন এ্যাটর্নী জেনারেল অফিস থেকে গণধর্ষণের ঘটনার দুই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলি করতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। ওই সময়ের এ্যাটর্নী জেনারেল অফিস আসামিদের রক্ষায় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে অভিযোগ উঠলেও সরকারের আইন মন্ত্রণালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আসামিদের রক্ষায় বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও কার্যত বিচার কার্যক্রমের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২৩ সালের ২৬ জুন আপীল বিভাগের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হরিপদ পাল স্বাক্ষরিত এক পত্রে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরীকে লিভ টু আপিল দায়েরের বিষয়ে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়। এরপর থেকে আসামিদেরকে সিলেটের আদালতে তেমন একটা হাজিরও করা হয়নি। ৫ আগস্টের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এমসি কলেজের গণধর্ষণের মামলা বিষয়ক প্রতিবেদন দৈনিক সিলেটের ডাকসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
সূত্র মতে, ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ গণধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মামলা দুটো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের চূড়ান্ত আদেশ দেন। ওই আদেশে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গেজেট জারি করতে বলা হলেও শুধুমাত্র তৎকালীন এ্যাটর্নী জেনারেল অফিসের কারণে হাইকোর্টের ওই আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে ১ আগস্ট বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বাদীপক্ষ একটি রিট দায়ের করলে ১৬ আগস্ট দুই মামলার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলির জন্যে প্রক্রিয়া গ্রহণে কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না,তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলার জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় আলোচিত গণধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও এরপর আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হক আট আসামির উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ১১ মে বুধবার গণধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা চাঁদাবাজি ও ছিনতাই মামলার অভিযোগ গঠন করেন।এর আগের বছর ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি রোববার ওই ট্রাইব্যুনালে সকল আসামির উপস্থিতিতে অপহরণ, গণধর্ষণ ও গণধর্ষণে সহায়তার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযোগ গঠন করা হয়।
গণধর্ষণ মামলার অভিযোগ গঠনের পর ওই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করলেও বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতে একসাথে একই আদালতে মামলা দু’টি চালানোর আবেদন করায় আবেদনটির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে যাননি।
এদিকে, ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই আসামি রবিউল ইসলামের জামিন শুনানিতে মামলার বিচার বিলম্বিত হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
সেই ধর্ষকরা কারা :
গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার পুত্র সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গির মিয়ার পুত্র শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের পুত্র তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের পুত্র অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের পুত্র রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের পুত্র মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার (বাসা নং-৭৬) মৃত সোনা মিয়ার পুত্র আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের পুত্র মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭) অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর দন্ডবিধি আইনের৩৪২/৩২৩/৩৭৯/৩৮৫/৩৪ ধারা তৎসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী , ২০০৩)এর /৭/৯/(৩)৩০ ধারায় অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে পুলিশ। এতে ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। ঘটনার মাত্র ২ মাস ৮ দিন পর ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেয়া হয়।
এদিকে, ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনিকে আসামী করে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯/১৯এ ধারায় অভিযোগপত্রটি জমা দেয়া হয়। ঘটনার ১ মাস ২৭ দিন পর অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
আদালতে অকপটে স্বীকারোক্তি :
গণধর্ষণের পর আইনশৃংখলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ধর্ষকদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত আট ধর্ষকের সকলেই ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপের গডফাদার রনজিত সরকারের অনুসারী। গ্রেফতারের পর ৮ আসামির সকলেই অকপটে একেবারে সহজ-সরলভাবে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। আসামিদের মধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ,মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ১৯ বছর বয়সী ওই নববধূকে সরাসরি গণধর্ষণ করে। রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণে সহযোগিতা করে।
ঘটনার পরে গ্রেফতারকৃত ৮ আসামির প্রত্যেকের ডিএনএ নমুনা ওসমানীর ওসিসির মাধ্যমে সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে প্রেরণ করে পুলিশ। ডিএনএ রিপোর্টে ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান , তারেকুল ইসলাম তারেক , অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ ‘ম্যাচিং’ পাওয়া যায়। এদিকে আইনুদ্দিন ও মিজবাউল ইসলাম রাজন’র ডিএনএ ‘মিক্সিং’ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ডিএনএ রিপোর্ট’র ফলে নিশ্চিত হওয়া যায়,এই ৬ জনই গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছিল। আইনুদ্দিন ও মিজবাউল ধর্ষণের সময় ‘কিছু ব্যবহার করায়’ ম্যাচিং এর বদলে রিপোর্টে মিক্সিং পাওয়া যায়। বাকী ৪ জন ‘কোনো কিছু ব্যবহার না করে’ সরাসরি ধর্ষণ করে বলে নিশ্চিত হয় সিআইডি।
গ্রেফতারের পর আদালত তাদের প্রত্যেককে ৫ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষে ৮ আসামীর সকলেই জবানবন্দিতে গৃহবধূকে তুলে নেয়াসহ গণধর্ষণ ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত আসামিরা সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে।
ভয়ঙ্কর সেই কালোরাত :
সেদিন ছিল শুক্রবার। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরের ২৪ বছর বয়সী এক যুবক তার ১৯ বছর বয়সী নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে প্রাইভেটকারযোগে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে যান। এর আগে শাহপরান (রহঃ) মাজারও ঘুরে আসেন তারা। সন্ধ্যার পরে এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে তারা থামেন। ওই সময় কয়েক যুবক ওই স্বামী ও তার স্ত্রীকে ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে প্রাইভেটকারসহ তাদেরকে জোরপূর্বক জিম্মি করে কলেজের ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। এরপর স্বামীকে আটকে রেখে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের ৫ম তলা বিল্ডিং এর সামনে প্রাইভেটকারের মধ্যেই গৃহবধূকে জোরপূর্বক গণধর্ষণ করে। তারা দম্পতির সাথে থাকা টাকা, স্বর্ণের চেইন ও কানের দুল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আটকে রাখে তাদের প্রাইভেট কারও। ছাত্রাবাস থেকে টিলাগড় পয়েন্টে এসে যুবকটি পুলিশে ফোন দেন। পুলিশ আসতে বেশ সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ পেয়ে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ নির্যাতিতাকে ওসমানী হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে। ওই রাতেই নির্যাতিতার স্বামী মাইদুল ইসলাম বাদী হয়ে ৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো ৩-৪ জনকে আসামী করে শাহপরান থানায় মামলা করেন। শাহপরান থানার মামলা নং- ২১। তারিখ-২৬/০৯/২০২১। দেশের অন্যতম পুরনো বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে সরকার ধর্ষণের সাজার আইনের পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ মৃত্যুদন্ডের ঘোষণা দেয়। ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান করে জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল ২০২০ পাশ হয়। এ ঘটনায় এমসি কলেজের ছাত্র সাইফুর রহমান, মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসানকে কলেজ কর্তৃপক্ষ স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ৪ জনের ছাত্রত্ব এবং সার্টিফিকেটও বাতিল করে।