সড়কে নিরাপত্তা কতদূর?
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১:২৩:৩৬ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম :
প্রতি বছর সাড়ম্বরে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস পালিত হলেও দেশের সড়কগুলোতে মৃত্যুর মিছিল কি থামানো যাচ্ছে ? সিলেটসহ সারাদেশে প্রতিদিনই সড়কে হতাহতের ঘটনা বাড়ছে। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে গতরাতেও সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন একজন পুলিশ সদস্য।
এমন বাস্তবতায় আজ বুধবার পালিত হচ্ছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, বিগত এক যুগে সড়কে ৬৭ হাজার ৮৯০টি দুর্ঘটনায় এক লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত ও এক লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ৩ হাজার ৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২ হাজার ৯৪৩ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর দেশে ৫ হাজার ৮৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে প্রতিদিন ১২-১৫ জন সড়কে নিহত হচ্ছেন। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
জানা গেছে, বাংলাদেশে সড়ক সংক্রান্ত প্রথম আইন প্রণীত হয় ১৯৮৩ সালে ‘মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স’ নামে। পরবর্তীকালে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে কার্যকর হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। এরপর ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর এ আইনের আওতায় জারি হয় ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’।
আইনে বলা আছে, মহাসড়কের উভয়পার্শ্বে ১০ মিটারের মধ্যে হাট-বাজার কিংবা অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এছাড়া ময়লা-আবর্জনা বা অন্য কোনো বস্তু ফেলা যাবে না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া মহাসড়কের সঙ্গে কোনো সংযোগ সড়কও নির্মাণ করা যাবে না। সরেজমিনে সিলেটের বিভিন্ন সড়ক মহাসড়কের পাশে উভয় সড়কের লাগোয়া দোকানপাটের দেখা মিলবে। সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক থেকে শুরু বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কেও স্থাপনার দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করা গেছে।
আইনে আরো বলা আছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ, হাট-বাজার বসানো বা ব্যবসায়িক উদ্দেশে ব্যবহার করা যাবে না। মহাসড়কের কোনো অংশ থেকে মাটি, বালু, পাথর বা সংশ্লিষ্ট কিছু উত্তোলন করা যাবে না। মহাসড়ক বা সংশ্লিষ্ট কোনো অংশে ময়লা, আবর্জনা বা অন্য কোনো বস্তু নিক্ষেপ করা যাবে না। কোনো ধরনের বস্তুও রাখা যাবে না। রাখা যাবে না নির্মাণসামগ্রীও। কিন্তু, সিলেট অঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কের পাশে এসব দৃশ্য যেন নৈমিত্তিক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়। সংস্থাটির ২০২১ সালের রিপোর্ট বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালের সংস্থাটির রিপোর্টে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৬৩৫ জনের। এছাড়া ২০২১ সালে এই মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো এবং ২০১৬ সালে প্রতি লাখে মৃত্যুহার ছিল ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র হিসাব মতে, প্রতি বছর দেশে গড়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ মারা যায় ও ১০ হাজারের বেশি বিভিন্ন মাত্রায় আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করে।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যানবাহনের চালক, যাত্রী এমনকি পথচারীরাও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। সড়কে মৃত্যু কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, মাদক গ্রহণ করে গাড়ি চালানো, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক ও পথচারীদের না মানার প্রবণতাকে বড় কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। এছাড়া যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা এবং ব্যবহারোপযোগী না থাকা, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, চ্যাট করা, সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের ওপর হাটবাজার গড়ে ওঠায় পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। সিলেট অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন মহাসড়কের সাথে সংযুক্ত ফিডার রোডগুলোও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাঙ্কিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘের সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেইফটি ২০২১-২০৩০ এ বর্ণিত পাঁচটি স্তম্ভ (নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা) কাজে লাগানো হলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার হ্রাস পাবে ও দীর্ঘমেয়াদী পঙ্গুত্ব থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ডাব্লিউএইচও ৫টি আচরণগত ঝুঁকি (গতি কমানো, সিটবেল্ট ব্যবহার, সঠিক হেলমেট ব্যবহার, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানো এবং শিশুদের জন্য বিশেষ সিটের ব্যবস্থা) মোকাবেলার প্রতিও জোর দিয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চলের মধ্যে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক সবচাইতে দুর্ঘটনাপ্রবণ। এই সড়কে প্রায় ৫৫টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ জুন ওই মহাসড়কের নাজিরবাজার এলাকায় দুর্ঘটনায় দিরাইয়ের ১৫ জন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ দুর্ঘটনার পর সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি জোরালো হয়। কিছুদিন পর সে প্রক্রিয়াও থেমে যায়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগে(সওজ) সিলেট-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন জানান, রোড ক্রাশ কমানোর জন্য সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক হচ্ছে। তিনি এও জানান, মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। তিনি বলেন, সিলেট-ঢাকা ছয় লেন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।
এক যুগে সড়কে প্রায় ৬৮ হাজার দুর্ঘটনা, প্রাণহানি এক লাখ ১৬ হাজার ৭২৬
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৫ উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিগত এক যুগে দেশে প্রায় ৬৮ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার নিহত ও এক লাখ ৬৫ হাজার আহত হয়েছেন। এ পরিসংখ্যানকে ‘সড়কে গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
তার অভিযোগ, ‘বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের নীতি ও কৌশল পরিবর্তন না হওয়ায় এমন দুর্ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। ফলে সড়কে গণহত্যা বন্ধে, যানজট ও দুর্ঘটনা কমানো, সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সিলেটে সড়ক নিরাপত্তা দিবসের কর্মসূচি
জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার সকাল ১০টায় সিলেটে র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে র্যালি বের হবে। পরে তাঁর (জেলা প্রশাসক) সম্মেলনকক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসক মো: সারওয়ার আলমের সভাপতিত্বে এতে বিভাগীয় কমিশনার খান মো: রেজাউন নবী প্রধান অতিথি এবং পুলিশ কমিশনার মো: আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী পিপিএম বিশেষ অতিথি থাকবেন।




