সিলেটের জেলা রেজিস্ট্রারের এ কেমন আচরণ!
কাবিননামা সময়মতো সত্যায়িত না করায় চরম ভোগান্তিতে প্রবাসীরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৩:৩৫:৪২ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : পরিবার বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কাবিননামা জেলা রেজিস্ট্রারের সত্যায়িত করা নিয়ে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সিলেটের প্রবাসীরা। সিলেট জেলা রেজিস্ট্রার মো. রিয়াজুল ইসলাম নিকাহ রেজিস্ট্রার বই নিয়ে ‘কাজী’-কে সরাসরি উপস্থিত হতে বলেন। কাজী উপস্থিত হতে না পারলে সত্যায়িত করছেন না। এ অবস্থায় কাজীকে জোর করে ধরে বা টাকা দিয়ে নিয়ে আসতে বলছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এতে বিদেশে আবেদনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় প্রবাসীসহ পরিবারের সদস্যরা চরম দুশ্চিন্তায়।
প্রবাসের আবেদনের মেয়াদ একবার চলে গেলে আরেকবার আবেদনের অনুমতি পেতে দীর্ঘদিন সময় লাগে। এতে পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
সিলেট জেলা রেজিস্ট্রার মো. রিয়াজুল ইসলাম টাকা দিয়ে বা জোর করে কাজীকে ধরে আনতে বলার কথা অস্বীকার করে বলেন, হয়তো বলেছি যেভাবে হোক কাজীকে নিয়ে আসেন। কাজী নিকাহ রেজিষ্ট্রার বই নিয়ে না আসলে তিনি সত্যায়িত করতে পারেন না।
তবে একাধিক কাজী সাহেবে জানান, শুধু সত্যায়িত করতে যদি বিভিন্ন উপজেলা থেকে ভলিউম নিয়ে কাজী সাহেবদের আসতে হয়; তবে কাজ করা দুরূহ হয়ে যাবে। উদাহরণ টেনে তারা বলেন, অনেক জেলায় কাজীরা কাবিনানামার ছবি তুলে হোয়টাসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছেন; সাথে সাথে জেলা রেজিষ্ট্রর সত্যায়িত করে দিচ্ছেন। কিন্তু সিলেটের রেজিস্ট্রার কেন এমনটি করছেন- তা কারোরই বোধগম্য নয়।
সূত্র জানায়, পরিবারের সদস্যদের বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বে কাবিননামা নোটারি করে আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হতো। দু’একদিনের মধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা সত্যায়ন করা যেত। এখন নতুন নিয়মে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। অনলাইনে আবেদন সরাসরি সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রার এর নিকট চলে আসে। তিনি সত্যায়িত করে দিলে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত হয়।
সিলেটে দীর্ঘদিন থেকে সত্যায়িত করার বিষয়টি ঝুলে আছে জানিয়ে এক প্রবাসীর আত্নীয় বলেন, ‘কাজী’ নিজে নিকাহ রেজিস্ট্রার বই নিয়ে উপস্থিত না হলে জেলা রেজিস্ট্রার তা সত্যায়িত করছেন না। আবেদনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও কোন ভ্রুক্ষেপ করছেন না জেলা রেজিস্ট্রার। কাজী উপস্থিত না হলে কাজীকে শোকজ’ অথবা তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষ চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে জেলা রেজিস্ট্রারের বক্তব্য হচ্ছে, কাজীকে জোর করে ধরে নিয়ে আসেন অথবা কিছু দিয়ে হলেও নিয়ে আসেন। শেষে নিজের অর্থ ও শক্তি ব্যয় করে কিছুদিন আগে কাজটি হয়েছে বলে জানান তিনি।
ভুক্তভোগী বলেন, গ্রাম থেকে একজন কাজী সাহেবকে জেলা শহরে যেতে অর্থ ও সময় ব্যয়ের বিষয় আছে। শুধু সত্যায়িত করতে কাজী সাহেব ভলিউম নিয়ে জেলায় ছোটাছুটি করবেন বিষয়টি বর্তমান যুগে অনেকটা হাস্যকর বলে মনে করেন তিনি।
অপর এক ভুক্তভোগী নারী জানান, তাঁর বিয়ের কাবিনে তারিখের জায়গায় ৬ লেখাটি ৫ এর মতো দেখা যাচ্ছে বলে বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছেন জেলা রেজিস্ট্রার। কাজীসহ সবাই সংখ্যাটি ৬ বলার পরও তিনি দিচ্ছেন না। এসএসসি সার্টিফিকেটেও ৬ দেখানোর পরও তিনি সত্যায়িত করেন না। পরে কাজী সাহেবকে বলেছেন, কেঁটে নিচে লিখে আবার স্বাক্ষর দেয়ার জন্য। কাজী সাহেব কেটে নিচে স্পষ্ট করে আবারো লিখে দিলে পরে বলেন, কাজী সাহেবের বই ভুয়া। কাজী সাহেবের বই এর অন্য কিছু পাতা ফাঁকা কেন উল্লেখ করে বইটিই ভুয়া বলে সত্যায়িত করেননি।
অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ঐ নারী জানান, তার অনুরোধে কাজী সাহেব দুইদিন এসেছিলেন। পরে কাজী সাহেব অপারগ হয়ে বইটি রেজিস্ট্রার অফিসে রেখে গেছেন। কোনভাবে পারলে আমরা যেন সত্যায়িত করে নেই। অনেক প্রবাসীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, বার্থ সার্টিফিকেট, এনআইডি অথবা একাডেমিক সার্টিফিকেট অনুযায়ী অনেকের কাবিনে কোথাও ‘মো.’ আবার কোথাও ‘মোহাম্মদ’ লেখা হয়েছে। এগুলো সংশোধন করে কাবিনে কাজী ইনিশিয়েল দিয়ে দিলেও সেসব মানছেন না জেলা রেজিষ্ট্রার। এ অবস্থায় বিদেশে আবেদনের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে বলে জানান প্রবাসীর স্বজনরা। একবার আবেদনের মেয়াদ অতিক্রান্ত হলে কয়েক বছর পিছিয়ে যায়। এমন অবস্থায় পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেবে বলে জানান তারা।
এদিকে, সিলেটে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০টি আবেদন জমা পড়ছে। সবমিলিয়ে জেলা রেজিস্ট্রার অফিসে প্রায় ১৫শ’ আবেদন পেন্ডিং(ঝুলে) অবস্থায় আছে। কাজী সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, ভোগান্তির কোন সীমা নেই। আবেদনকারী চরম হয়রানির মধ্যে থাকেন। তারা সব সময় যোগাযোগ করেন। আমাদেরও নিকাহ রেজিষ্ট্রার নিয়ে সিলেট শহরে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।
হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে করা যায় কিনা- জানতেই চাইলে কাজী সমিতির এক নেতা বলেন, অনেক জেলায় কাবিননামার ছবি তুলে হোয়টাসঅ্যাপে দিয়ে দিলেই মিলিয়ে নিয়ে সত্যায়িত করে দেয়া হচ্ছে। জেলা রেজস্ট্রারের সাথে অনেক বার এসব নিয়ে কথা বলেছি। আবেদনকারী ও কাজীদের ভোগান্তির কথা বলেছি। কিন্তু তিনি কিছুই শুনছেন না। সাধারণ মানুষের পেরেশানি এবং কাজী সাহেবদের ভোগান্তি নিয়ে আমরা নিজেরাই অসহায় হয়ে পড়েছি।
নিকাহ রেজিস্ট্রারে সংশোধনীর ব্যাপারে ভোগান্তির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, কাবিননামায় অনেক সময় নামের শুরুতে ছেলেদের মোহাম্মদ ছোট বড় করে লেখা, মেয়েদের মোছা. থাকা না থাকা, বেগম খানম নিয়ে ভুল করেন। ফলে এসব বিষয় এনআইডি, সার্টিফিকেট দেখে সংশোধনী করে ইনিশিয়েল দিলেও জেলা রেজিস্ট্রার বিষয়টি মানছেন না। তিনি বলেন, কাজী সাহেব সংশোধন করতে পারেন না। আমরা বলেছি, ইস্যুকারী কর্মকর্তা হিসেবে কাজী সাহেব সংশোধন করতে পারেন, যদি না পারেন, তবে আইনটি আমাদের দেখান। তখন আবার কিছুই বলছেন না। একদিকে সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে কর্মকর্তাদের বিধিনিষেধ, আমরা আছি চরম অস্বস্তিতে।
নিকাহ রেজিস্ট্রার বই ভুয়া অথবা কাজী সাহেব না আসলে বা সংশোধনী যদি অবৈধ হয়; তবে কাজী সাহেবের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা- জানতে চাইলে সিলেট জেলা রেজিষ্ট্রার মো. রিয়াজুল ইসলাম কোন ব্যবস্থা নেননি বলে জানান। এজন্য সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা উল্লেখ করলে তিনি বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখবে বলে জানান। এসব বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক কাজী আব্দুল হান্নানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।




