আইনী জালে বন্দি প্রবাসীরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১:০৭:২৬ অপরাহ্ন
মাহমুদ রহমান :
সম্পদ সবার কাছেই মূল্যবান। মানুষ পাগলের মতো জীবনভর সম্পদ উপার্জনের পেছনে ব্যয় করে। লক্ষ্য একটাই- যাতে সম্পদ উপভোগের মাধ্যমে জীবন স্বাচ্ছন্দময় হয়। অবশ্য কেউ কেউ সম্পদ ভোগের চেয়ে আহরণে এত মগ্ন থাকে যে, তার জীবনে এ সম্পদ কোনো কাজেই লাগে না। সারাজীবন পরিশ্রম করে জমি-বাড়ি ও ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়ে মৃত্যুবরণ করার পর, পরবর্তী বংশধরেরা তা উপভোগ করেন। কিন্তু অনেক মানুষ রয়েছেন, যাদের এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ নেই। সে তার নিজের জীবনের সেই সম্পদ ভোগ করতে চায়। কিন্তু আইনী জটিলতায় পড়ে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই শ্রেণীর ভুক্তভোগী বেশিরভাগ প্রবাসীরা। বিশেষ করে যারা ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হিসেবে নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
এই জানুয়ারী মাসের ২৬ তারিখ ঢাকা থেকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে আমেরিকায় আসার পথে দু’জন বাংলাদেশী আমেরিকান নগদ এক লাখ ডলারসহ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেফতার হয়েছেন। পরদিন শনিবার সকালে বিমানবন্দর সূত্র এবং বিমানবন্দর থানার ডিউটি অফিসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বলে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এ দু’জন বাংলদেশী আমেরিকানের বিস্তারিত পরিচয় এবং এত বিপুল পরিমাণ ডলার অনুমোদন ব্যতিরেকে বহন করার কারণ জানা যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে আনীত মামলার তদন্তের অগ্রগতি হলে হয়তো আমরা এ টাকার উৎস এবং এভাবে পরিবহনের কারণ জানতে পারবো। তবে আমেরিকান বাংলাদেশীরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে ধারনা করছেন, হয়তো বা ডলারগুলো দেশে তাদের কোনো সম্পদ বিক্রির টাকা। বাংলাদেশ থেকে সহজে টাকা বিদেশে নিয়ে আসার সুযোগ নেই। তাই তারা হয়তো এভাবে অবৈধপথে তাদের বৈধ টাকা নিয়ে আসার ঝুঁকি নিয়েছেন।
যারা প্রচুর টাকার মালিক, তাদের সামনে অনেক পথ খোলা থাকে। টাকা কীভাবে বিদেশে আনা যায়, সহজে তা তাদেরকে বলে দিতে হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ পড়ে যান বিড়ম্বনায়। মনে করুন শেষ বয়সে একটি পরিবার আমেরিকার পথে পা বাড়ালো। কয়েক বছর আমেরিকায় বসবাসের পর তাদের মনে হলো এখানে অর্থ-উপার্জন করে জীবনযাপন করা অনেক কঠিন। আবার দেশে ফিরে গেলে তাদেরকে দেখারও খুব কাছের কেউ নেই। এরকম দুটানায় পড়ে ভাবলেন দেশে তাদের শহরের বাসা কিংবা কিছু জায়গা জমি বিক্রি করে নিয়ে আসতে পারলে আমেরিকায় একটি বাড়ি কিনতে পারবেন। এতে তাদের বাড়ি ভাড়ার ব্যয় কমে যাবে। অন্যন্য ব্যয়- কিছু উপার্জন এবং কিছু সরকারি সহযোগিতায় মেটানো কঠিন হবে না। এতে একদিকে সব ব্যয়সংকুলানের মতো কঠোর পরিশ্রম করা থেকে রেহাই পাবেন। অন্যদিকে বৃহত্তর পরিবারের সবার সঙ্গে বসবাসের সুযোগও হাত ছাড়া হবে না।
এই ভাবনা থেকে যখন বাংলাদেশে গিয়ে তাদের বাড়ি-জমি বিক্রি করবেন, তখনই পড়বেন আসল সমস্যায়। প্রথমেই বিক্রি চুক্তির পর দলিল রেজিস্ট্রি করতে গেলে দেখবেন বাংলাদেশের আইডিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো তার হয়তো নেই। একে ওকে ধরে টাকা পয়সা খরচ করে দলিল রেজিস্ট্রি করে যখন হাতে পাবেন টাকা, তখন শুরু হবে আরেক যন্ত্রণা। আমেরিকায় টাকাগুলো কীভাবে আনবেন? তিনি হয়তো ব্যাংকে গিয়ে বলবেন, টাকাগুলো ডলারে কনভার্ট করে আমেরিকায় পাঠানোর জন্য। ব্যাংক জানিয়ে দিবে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা ব্যয়, শিক্ষা ব্যয় এবং ভিজিট ব্যয় সংকুলানের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলারের চেয়ে বেশি পাঠানোর অনুমতি নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্যাপিটাল ট্রান্সফার অনুমোদন করে না। এখন এই পরিবারের মাথায় হাত! তারা এত টাকা কীভাবে বিদেশে নিয়ে আসবেন। কেউ কেউ যাবেন হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে। ওরা ডলারের কনভার্ট রেইট অনেক বাড়িয়ে ধরবে। তারপর বলবে কিছু টাকা বিদেশে ব্যাংক একাউন্টে আর কিছু হয়তো নগদ কারো কাছ থেকে সংগ্রহ করার জন্য। হুন্ডি ব্যবসায়ীর কথা শুনে বুকের একপাশ বলছে বিশ্বাস করতে, আর অন্যপাশ অবিশ্বাস করছে। কিন্তু নিরুপায় হয়ে লোকটি হুন্ডি ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করে দেশ থেকে আমেরিকায় ফিরে আসলেন।
হুন্ডি ব্যবসায়ীর প্রতিনিধির কাছ থেকে নগদ ডলারের অংশটি সংগ্রহ করে ঘরে এনে রাখলেন। আগুন লাগলে পুড়ে যাওয়া, চুরি হওয়ার ভয় প্রতিনিয়তই তার রয়েছে। তবুও কথামতো ডলার পেয়ে গেছেন তাতেই অনেক খুুশি। তারপর হয়তো যাবেন ব্যাংকে। সেখানে গিয়ে দেখলেন একাউন্টে কোনো টাকা নেই। হুন্ডিওয়ালার কাছে দিলেন ফোন। হুন্ডি ব্যবসায়ী জানালো বাংলাদেশ থেকে তো ব্যাংকে টাকা পাঠানো যায় না। তাই দুবাই থেকে আপনার একাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু টাকার উৎস এবং কেনো পাঠানো হচ্ছে এ ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা না পেয়ে টাকা আটকে দিয়েছে আমেরিকার ব্যাংক। এবার হুন্ডিওয়ালার কাছে প্রতিদিন ফোন। উত্তরে, দেখছি। চেষ্টা করছি। আটক টাকা ফেরত পেলেই আপনাকে নগদ দিয়ে দিবো। এরকম প্রতিশ্রুতি প্রতিদিনই শোনাবে। ভদ্রলোকের হয়তো উচ্চরক্তচাপ বেড়ে গেছে। আগে যেখানে একটি ওষুধ প্রতিদিন খেতেন, এখন সেখানে দুটো খেয়েও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যাংকে আটক টাকা ফেরত পাওয়া পর্যন্ত হার্ট এট্যাক বা স্ট্রোকের হাত থেকে রক্ষা পেলেও পরবর্তীতে পড়বেন আরেক সমস্যায়। আমেরিকায় নগদ টাকায় বাড়ি কিনতে হলে টাকাগুলো ব্যাংক একাউন্ট হতে আসতে হয়। কেউ বস্তায় ভরে টাকা নিয়ে গিয়ে বাড়ি কিনতে পারে না। এখন এই ভদ্রলোক আমেরিকায় আইনী ফাঁকফোকর গলে ডলার কীভাবে উপস্থাপন করবেন তা চিন্তা করতে করতে বাড়ি কেনার ইচ্ছাই হয়তো চলে যাবে।
আরেকজন হয়তো যৌবনে প্রবাসে ভালো রোজগার করে দেশে সম্পদ কিনেছে। বৃদ্ধ বয়সে এখন শরীরে আগের মতো শক্তি নেই। ছেলে বিয়ে, মেয়ের বিয়েসহ অন্যান্য প্রয়োজনে তাঁর টাকার প্রয়োজন। এই ব্যক্তিও বিদেশের টাকায় কেনা সম্পদ বিক্রি করেও বিদেশে বৈধভাবে নিয়ে যেতে পারবে না আইনী মারপ্যাঁচে। ফলে বিপুল সংখ্যক ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে এখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা পাঠাতে চায় না।
অন্যদিকে শত শত কোটি টাকা যারা পাচার করছে তাদের রয়েছে দেশে বিদেশে আমদনী-রফতানী লাইসেন্স। আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা প্রতিদিনই পাচার করছে। সবকিছুই ব্যাংকিং চ্যানেলেই হচ্ছে। আমেরিকায় বুক ফুলিয়ে বাড়ি গাড়ি কিনছে। বাংলাদেশেও সে সেলিব্রেটি।
তাই বাংলাদেশ থেকে ক্যাপিটাল ট্রান্সফারের সুযোগ বন্ধ করে সত্যিকারভাবে অর্থপাচার রোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ২০২৩-২৪ সালের বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে গিয়ে জানায়, স্বাধীনতার পরবর্তী অর্থ-বছর থেকে বিগত ৫০ বছরে ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য তুলে ধরেছে। এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর ২৪ হাজার কোটি টাকা করে বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে। এছাড়া সুইস ব্যাংকের ডিপোজিট, কানাডার টরেন্টোর বেগম পাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম সহ দেশ থেকে পাচারকৃত টাকার খবরা-খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় হরহামেশা দেখা যায়। বাংলাদেশ থেকে বৈধ উপায়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা ট্রান্সফার করতে না দিয়ে সত্যিকার পাচারকারীদের আটকাতে পারছে না সরকার। বরং সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ সংক্রান্ত নীতিগুলো পর্যালোচনা করা। যে আইন চুরির পথ আটকাতে পারে না। উল্টো সাধারণ মানুষকে হয়রানি করতে সহযোগিতা করে সে আইন থাকা কতটা যৌক্তিক তা নীতি নির্ধারকদের বিবেচনা করতে হবে। বিদেশে অনেক টাকাওয়ালা মানুষ আছে যারা চাইলে দেশে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু তারা প্রয়োজনের সময় আবার বিদেশে টাকা নিয়ে আসার জটিলতায় এ পথে পা বাড়ায় না। প্রবাসী অনেকেই যেমন জমি-বাড়ি বিক্রি করে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন তেমনি অনেকেই কিনতেও চাইবে। যদি এ আইন পরিবর্তন করা হয়। এ এমন এক আইন যা রাঘব বোয়ালদের আটকাতে পারছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে ডলার পাচারকারী বানিয়ে ফেলছে। নিজের বৈধ টাকা শুধু বৈধপথে আনতে না পারায় মানিলন্ডারিংয়ের ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ বিষয়টি আন্তরিকভাবে বিবেচনা করা। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ, আইনশৃংখলা ও বিচারব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া পূঁজি ধরে রাখা কঠিন। কৃত্রিম আইনি বেড়াজালে আটকে যে রাখা যাচ্ছে না- তা অর্থনীতি সমিতি সহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশী গবেষকদের তথ্য থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দেশে সম্পদের নিরাপত্তা এবং বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নয়নই পূঁজি ধরে রাখার প্রকৃত পথ। মৌলিক এ পথে না হেঁটে আইন দিয়ে আটকাতে চাইলে অসংখ্য হুন্ডি ব্যবসায়ীর জন্ম হবে। আর সাধারণ মানুষ ডলার পাচারকারী হিসেবে ঢাকার বিমানবন্দরে বসে চোখের পানি ফেলবে। অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারীরা আমেরিকার লাস ভেগাসের ক্যাসিনোতে বসে মুচকি হাসবে। এ হাসি ভুল নীতির প্রতি বিদ্রুপের হাসি। তাই মুক্ত বাণিজ্যের এ বিশ্ব ব্যবস্থায় পূঁজির অবাধ চলাচলে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ না করলে নয়- এরচেয়ে একটুও বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত নয়।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র।