একুশের চেতনা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৪:৩৩:৫১ অপরাহ্ন
ড. মো. হাফিজুর রহমান :
বাঙালি জাতিসত্তার সর্বপ্রথম এবং শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হচ্ছে মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি। বাঙালি জাতির ঐতিহ্য সন্ধান করলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের জাতিগত চেতনার বীজমন্ত্র সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বহমান। শুধু বহমান বললে ভুল হবে, আমার চেতনায় বাঙালিত্বের এ ব্যপ্তি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। একুশ একটি আত্মিক চেতনা, একটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি এবং বীরত্বের প্রতীক। এটি এমন একটি মহান বিপ্লব যা এনে দিয়েছে বিশ্বের বুকে বাঙালির পরিচয়।
লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে রাষ্ট্র্রভাষার প্রশ্নে নানা রকম টানাপোড়েন চলতে থাকে। উর্দুকে রাষ্ট্র্রভাষা করলে পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয় বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন। খ- খ- এই আন্দোলন একীভূত হয় ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারি। এইদিনে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বাঙালির জীবন উৎসর্গের ঘটনা গড়েছে এক অনন্য ইতিহাস।
বাঙালি জাতিকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অমর একুশের রয়েছে সীমাহীন অবদান। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি খুঁজে পায় স্বাধীনতার স্বপ্ন। আজ সারাবিশ্বে একুশের চেতনা প্রবাহিত হচ্ছে। একুশ আজ কেবল বাঙালির জাতীয় ইতিহাস নয় বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তা ভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একুশের এ বিশ্বময় স্বীকৃতি সমগ্র বাঙালি জাতির গর্বের বিষয়।
একুশের ইতিহাস বাঙালির গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ফসল একুশ। ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই বাঙালি জাতির চেতনায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের তরঙ্গ প্রবাহিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর রাষ্ট্রভাষা নিয়ে অবাঞ্চিত পরিস্থিতির অবতারণায় একুশে ফেব্রুয়ারির মত কালজয়ী দিবসের জন্ম। তৎকালে তদানীন্তন পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন। ফলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনগণ।
১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভাষার দাবি চলতে থাকে পূর্ব বাংলায় পর্যায়ক্রমে এই আন্দোলন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের শুরুতেই ২৬ জানুয়ারি তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘােষণার পুনরাবৃত্তি করেন। এতে করে পাকিস্তান সরকার ও ছাত্র সমাজের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষ ।
ইতোমধ্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন ও সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয় পূর্ব বাংলায়। আন্দোলন দমন করার জন্য পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে জনসভা, মিছিল বন্ধ করে দেবার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধরা ভেঙে মিছিল বের করে। এ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে। শহিদের এ আত্মত্যাগ আন্দোলনকে স্তিমিত না করে আরও বেগবান করে। মাতৃভাষার দাবিতে রক্তাক্ত একুশের স্মৃতিকে ভাস্বর করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে গড়া হয় শহিদ মিনার। যা আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবােজ্জ্বল ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হয়ে আছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।