সেই ১৬ জনই আসামি, নতুন করে কারও সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেনি, র্যাবের দু’বছরের অধিকতর তদন্ত
২৮ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চৌধুরী হত্যাকান্ডের সম্পূরক চার্জশিট
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২৫, ১২:৪৯:৩৫ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের সর্বকনিষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু হত্যাকান্ডের ২৮ বছর পর মামলার সম্পূরক চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে র্যাব।
টানা দু’বছরের অধিকতর তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিটটি দাখিল করা হয়। মামলার এজাহারে বর্ণিত ১৬ জনকেই এই সম্পূরক চার্জশিটেও আসামি করা হয়েছে। আর মৃত্যুবরণ করায় মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ১৩ জনকে।
তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে র্যাব বলছে, দীর্ঘ ২৮ বছর পূর্বে ঘটনাটি সংঘটিত, তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ও আসামি মৃত্যুবরণ করায় এবং অনেক সাক্ষীকে তাদের ঠিকানায় না পাওয়ায় ব্যাপক তদন্ত করেও এই হত্যাকান্ডে আর কারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততা আছে মর্মে কোনো নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি ।
জানতে চাইলে অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাবের এসআই মো. ইমাম হাসান সিলেটের ডাককে বলেন, ২৮ বছর আগে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর হওয়ায় ইতোমধ্যে বহু সাক্ষ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা দুরূহ হয়ে উঠেছিল। তবুও টানা দু’বছর তদন্ত করে ঘটনার আদ্যপান্ত, রহস্য উদঘাটন, খুনীদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত অনেকেই মারা গেছে। যার ফলে নতুন করে কাউকে আসামি করা সম্ভব হয়নি। তবুও ন্যায় বিচারের স্বার্থে যথাযথভাবে অধিকতর তদন্ত শেষে সম্পূরক চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে।
যাদেরকে আসামি করা হয়েছে :
জানা গেছে, সম্পূরক চার্জশিটে জগন্নাথপুর উপজেলার বেতাউকা গাদিয়ালা গ্রামের জমসেদ উল্লার পুত্র শাহিন উদ্দিন প্রকাশ শাহিন, একই গ্রামের আছদ্দর আলীর পুত্র লিটন, মৃত আব্দুল মনাফের পুত্র লিয়াকত আলী, মৃত আব্দুস ছোবহানের পুত্র আব্দুল হক, আছদ্দর আলীর পুত্র রিপন মিয়া, আব্দুস ছোবহানের পুত্র ছাদ আলী,আবুল হোসেনের পুত্র আব্দুল হামিদ প্রকাশ হামিদ মিয়া, তৌহিদ উল্লার পুত্র কলমদর উল্লা, মৃত সাফাত উল্লার পুত্র আব্দুর রশিদ ও আব্দুল মালিক প্রকাশ মালেক, সরদার উল্লার পুত্র কবির, আবুল হোসেনের পুত্র আব্দুল হালিম প্রকাশ নান্দু, মৃত তাজ মিয়ার পুত্র আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী, আব্দুস শহিদ প্রকাশ সাজেদ উল্লার পুত্র নিজাম, আব্দুল আজিজের পুত্র আবু সাহেদ প্রকাশ শহিদ ও খুরশেদ মিয়া চৌধুরীর পুত্র আব্দুল আহাদ চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে। র্যাব-৯ সিলেট, সিপিসি-৩ সুনামগঞ্জের এসআই মো. ইমাম হাসান তদন্ত শেষে গেল নভেম্বর মাসে সম্পূরক চার্জশিট সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর আমলগ্রহণকারী আদালতে দাখিল করেন।
জগন্নাথপুর থানার সম্পূরক চার্জশীট নং- ৩৬(ক)। ধারা১৪৩/ ১৪৭/ ১৪৮/ ১৪৯/ ৩০২/ ১১৪ পেনাল কোড ১৮৬০।
সূত্র জানায়, এ সকল আসামি হত্যাকান্ডের পর দায়েরকৃত মামলার এজাহারেও আসামি ছিল। সেই আসামিদেরকে সম্পূরক চার্জশিটে আসামি করা হয়েছে।
মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন ১৩ জন
সম্পূরক চার্জশিটে সর্বমোট ১৩ আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা চার্জশিটে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, যে এই ১৩ আসামি ঘটনার পরে বিভিন্ন সময় মৃত্যুবরণ করেছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা থেকে মৃত্যু সনদ দিয়ে তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। মরে গিয়ে মামলার দায় থেকে বেঁচে যাওয়া ১৩ জন হলেন, জগন্নাথপুর পৌর এলাকার ইকড়ছইর করম আলী, উপজেলার বেতাউকা গাদিয়ালার জালাল, আব্দুল কাইয়ূম, আব্দুল খালিক, ওয়াজেদ উল্লা, সিরাজ, আব্দুল হাসিম প্রকাশ হাসেম, রফিক, আব্দুল আজিজ প্রকাশ আজিজ, আব্দুল কাদির, আবুল হোসন চৌধুরী, আব্দুল বারিক প্রকাশ বারিক উল্লা এবং সরদার উল্লা। এর মধ্যে করম আলী ছিলেন বাচ্চু চৌধুরীর দেহরক্ষী, ঘটনার সময় বাচ্চু চৌধুরীর লাইসেন্সকৃত বন্দুক করম আলীর হাতে থাকলেও সেটি প্রাণরক্ষায় চাইলে বাচ্চু চৌধুরীর হাতে দেয়া হয়নি। বাচ্চু চৌধুরী হত্যাকান্ডের সাথে করম আলীর সমর্থন, বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিল ও জড়িত থাকার বিষয়ে তদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে বলে সম্পূরক চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল ঘাতক লিয়াকতসহ ৩ জন অধরা
র্যাবের তদন্তে যে ক’জন পলাতক আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা ঘটনার পর থেকেই পলাতক। র্যাবের সম্পূরক চার্জশিটে বলা হয়, আসামি লিয়াকত আলী, রিপন ও শাহীন মিয়া পলাতক এবং তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করতে আদালতের নিকট আবেদন জানানো হয়েছে।
সূত্র বলছে, সর্বপ্রথম এই লিয়াকত আলী বাচ্চু চৌধুরীকে সুলফি দিয়ে ঘাই মেরে হত্যা করে। গাদিয়ালার বাসিন্দা লিয়াকতসহ এই ৩ জন পলাতক থাকলেও এদের অবস্থান সম্পর্কে র্যাব কোনো ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি। এমনকি এদের ব্যাপারে আজও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট কোনো তথ্য নেই।
র্যাবের তদন্তে যা উঠে এসেছে :
বাচ্চু চৌধুরী এলাকায় একনিষ্ঠ নেতৃত্ব ও আধিপত্যের কারণে এলাকার লোকজন তাকে মান্য করতেন। এলাকার বিচার শালিসও করতেন। অবসর সময়ে এলাকার অনেকে মদ্যপানসহ জুয়া খেলায় লিপ্ত থাকত। এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদ করায় তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে যান বলে র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে। এছাড়াও দিরাই উপজেলার হোসেনপুরের আব্দুস সোবহান নামের এক জেলের বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তদন্তে আরও কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, প্রথম দফার চার্জশিট দাখিলের পরে ১৯৯৭ সালের ৮ এপ্রিল মামলার অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও ১৫ বছরে মামলার ১৮ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দেন। ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করলেও বহুবার তারিখ ধার্য্য করলেও আর রায় ঘোষণা করা হয়নি। একসময় আদালতের নিকট তদন্তে ত্রুটি ও প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত ধরা পড়লে ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজ (১ম আদালত) মহিউদ্দিন মুরাদ মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে এলিট ফোর্স র্যাবকে আদেশ দেন।
বিচারের আশায় নিহতের স্বজনরা :
নিহতের স্বজনরা জানান, হত্যাকান্ডের দীর্ঘ প্রায় তিন দশক হতে চললেও তারা এখনো বিচারের আশায় চেয়ে আছেন। প্রকাশ্যে জনসম্মুখে হত্যার পরেও কেবল একটি কুচক্রী মহল বাচ্চু চৌধুরী হত্যা মামলার ন্যায় বিচারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু র্যাবের এই অধিকতর তদন্তের পর এবার ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে বলে তারা মনে করেন।
নিহতের স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী বলেন, র্যাব তদন্ত কর্মকর্তা আমার কাছে এসেছিলেন। তারা আমার বক্তব্য নেন। ন্যায় বিচারের আশায় এখনো চেয়ে আছি। তিনি ন্যায় বিচারের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান। একইভাবে নিহতের একাধিক স্বজনও আসামিদের যথাযথ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
ফিরে দেখা সেই রোববার :
সেদিন ছিল রোববার। ১৯৯৬ সালের ৭ জানুয়ারি। ওইদিন সকালে জগন্নাথপুর উপজেলার গাদিয়ালা নদীর পশ্চিম পাড়ে স্থানীয় একদল সন্ত্রাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চুকে (৪২) কুপিয়ে হত্যা করে। নিহত বাচ্চু চৌধুরী পার্শ্ববর্তী বেতাউকা গ্রামের আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরীর ২য় পুত্র। তখনকার সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সাহসী রাজনীতিক বীরমুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চৌধুরীকে নিজ বাড়ির অদূরে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই আব্দুল মুকিত চৌধুরী লেবু মিয়া বাদী হয়ে পরদিন ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে জগন্নাথপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহার জগন্নাথপুর থানার তৎকালীন ওসি হুমায়ুন কবির সরকার নিজ হাতে লিখে দেন।
সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা :
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫নং সেক্টরের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু। জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লাসহ অনেক এলাকায় দাস পার্টির (মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর হাওর এলাকার বিশেষ দল) সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি। অদম্য সাহসী বাচ্চু ছুটে যেতেন পাকবাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের খোঁজে। তার অসীম সাহসের কথা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে শোনা যায়। দাস পার্টির প্রধান জগৎ জ্যোতি দাস শহীদ হবার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু দাস পার্টিকে কমান্ড করেন। তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ কমান্ডার। তিনি লাল বাহিনী নামের আরেকটি বাহিনীরও কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধকালীন তার অসীম সাহসে ভাটি বাংলায় অনেক ঘর-বাড়ি পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদরদের আগুন ও লুটপাট থেকে রক্ষা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। দু’বার জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামান্য ভোটে পরাজিত হন। তিনি জগন্নাথপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। জগন্নাথপুর সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান রয়েছে। জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের স্বরূপ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় ও জগন্নাথপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সরকারিকরণেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্যে স্থানীয় সরকারি খাদ্য গোদামের তালা ভেঙে দেয়ার ঘটনায় তিনি দেশব্যাপী আলোচিত হন।