ঈদের একাল-সেকাল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২৫, ১২:৪৪:৪০ অপরাহ্ন
সেলিম আউয়াল :
পবিত্র ঈদুল আযহা সমাগত। সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা। ঈদুল আযহা ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর একটি দিবস। আল্লাহর রাহে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সর্বস্ব ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ঈদুল আযহা। ঈদের এই চেতনা, ঈদের এই শিক্ষা চিরন্তন। ঈদ আমাদের জীবনে চিরন্তন এই বার্তা নিয়েই আসে। আবার ঈদকে কেন্দ্র করে আমরা নানা আচার-কর্মকাণ্ডও সম্পাদন করি। এজন্যে দেখা যায় শিশু বয়সে ঈদ নিয়ে আমাদের এক ধরনের আচরণ, আবার পরিণত বয়সে আরেক ধরনের। আবার গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমরা যারা ৬০ পেরিয়েছি তারা শৈশবে ঈদ নিয়ে যে আচরণ করেছি, আজকের শিশুরা তা করছে না।
আমাদের শৈশবে ঈদের চাঁদ দেখার জন্যে আমরা খোলা মাঠে যেতাম, ছাদে উঠতাম। গাছের ফাকফোকর দিয়ে, আকাশে মেঘের ভেলার ভাজে ভাজে আমরা চাঁদ খুঁজতাম। কখনো দেখতাম, কখনো দেখা হতো না। তখন রেডিওতে ঈদের চাঁদ দেখার খবর শুনতে আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে বড়োদের পাশে বসতাম। সেটা ছিলো ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা।
ঈদুল আযহার চাঁদ দেখার জন্যে আমাদেরকে ঈদের আগের সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ খুঁজতে হয় না। বেশ কয়েকদিন আগেই জানা যায় ঈদের খবর।
ঈদে একটি অন্যতম বিষয় ছিলো কেনাকাটা। আজকাল যেমন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঈদ ফ্যাশন নিয়ে ভাবে, আমাদের তেমনটি ছিলো না। গ্রামের লোকজন গঞ্জ থেকে কেনাকাটা করতো। শহরে আমাদের যাদের বাস, তারা শহরের মার্কেট থেকে কাপড় কেনা কাটা করতেন। এখনো অনেকে করেন। আজকাল অনেকে আবার ঈদের কেনাকাটা সারেন অনলাইনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ডিজাইন দেখে অর্ডার করেন। টাকা পাঠিয়ে দেন বিকাশে, নগদে। কুরিয়ার সার্ভিসে কাপড় চলে আসে বাসা-বাড়িতে।
আগে ঈদের কাপড় নিয়ে খুব লুকোচুরি হতো। কেউ যাতে ঈদের আগে কাপড় দেখতে না পায়, সেজন্যে কতো প্রচেষ্টা! ছোটদের মনে এক ধরনের ধারনা ছিলো, ঈদের আগে কাপড় দেখে ফেললে ঈদ চলে যাবে।
ঈদের ভোরে গোসল-টোসল সেরে আমরা ছুটতাম ঈদগাহ পানে। কেউ পরতেন নতুন জামা-কাপড়, কেউ বা পুরনো জামাকাপড় ধুয়ে। কাপড়ে লাগাতেন নানা জাতের আতর। সিলেট শহরের লোকজনের বেশির ভাগই যেতেন ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহে। কেউ কেউ হযরত শাহজালাল (রহ.)-র দরগাহেও যেতেন। আজকাল অবশ্য প্রায় পাড়ার মসজিদেই ঈদের জামাত হয়। এটা বেশি দেখা যায় ঈদুল আযহায়, আর বৃষ্টি হলে ঈদুল ফিতরেও পাড়ার মসজিদে ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়।
আগে ঈদের একটি কালচার ছিলো বন্ধুদের কাছে ঈদ কার্ড দেয়া। তখন ছিলো ছাপানো ঈদ কার্ড। আমরা ভীষণ ভাবতাম, ঈদকার্ডের ভাষাগুলো কেমন হবে। আবার আমার কাছে আসা একটি ঈদ কার্ড কিভাবে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যায়, এ নিয়ে চলতো নানা গবেষণা। আর আজকাল, মোবাইল ফোন দিয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানানো হয় ঈদের শুভেচ্ছা।
আমাদের শৈশবে সিলেটে টিভি স্টেশন ছিলো না। এজন্যে তখন টিভির ঈদের আনন্দ মেলা, ঈদের নাটক এইসব নিয়ে ভাবনা আলোচনা ছিলো না। পরবর্তী সময়ে সিলেটে টিভি স্টেশন চালু হবার পর খুব সহজে টিভির অনুষ্ঠান দেখা যেতো। একসময় রঙ্গিন টিভি চালু হলো। টিভির অনুষ্ঠানের জন্যে মানুষের কতো আগ্রহ। কিছু কিছু নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যখন টিভিতে দেখাতো, সেই সময়ে পুরো পাড়া ক্যামন ঝিম মেরে যেতো। আর আজকাল পছন্দের একটি গান শুনতে, পছন্দের একটি বিষয় জানতে প্রায় সবাই চলে যান ইন্টারনেট জগতে।
সেই দিনগুলোতে ঈদে কোনো কোনো পাড়ায় উৎসাহী তরুণেরা দেয়াল পত্রিকা বের করতো। কেউ কেউ ঈদ সংকলন ছাপতো। বিভিন্ন পত্রিকা ঈদে বিশেষ সংখ্যা বের করতো। বিভিন্ন পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখতাম অমুক লেখককে ডিস্টার্ব করবেন না, তিনি অমুক পত্রিকার জন্যে উপন্যাস লিখছেন। সে সময় এটা ছিলো বিরাট পাওয়া। ঈদ সংখ্যাগুলোতে সামান্য পয়সায় একসাথে অনেকগুলো গল্প উপন্যাস পেয়ে যাওয়া। তাও দেশের বড়ো বড়ো লেখকদের। এখন আগের মতো ঈদ সংখ্যার প্রতি এতো আগ্রহ নেই। অনেকে পড়াশোনার কাজটা ইন্টারনেটেই সেরে নেয়।
আগেই বলেছি কোরবানির ঈদে চাঁদ দেখার ব্যাপার নেই। অনেক আগে ভাগেই জানা যায় ঈদের দিনটি কখন। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও সিলেটে সবচেয়ে বড়ো পশুর হাট ছিলো কাজির বাজারে। এখনো কাজির বাজার প্রধান পশুর হাট। তবে সেই হাটের পাশাপাশি এখন সিলেট শহর আর আশেপাশের এলাকায় অনেকগুলো পশুর হাট। তখন প্রায় সবাই ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই বাজারে ঘুরে ঘুরে দেখেশুনে গরু কিনতেন। কেউ কেউ বিক্রেতারা হাটে নিয়ে যাবার পথে পছন্দ হলে, দরে-দামে পুষলে গরু অথবা ছাগল কিনে নিতেন। আজকালও পশু সেইভাবে কেনা হয়। আবার কেউ কেউ সরাসরি খামার থেকে পশু কিনেন। আজকাল সিলেট শহরের আশেপাশে অনেকগুলো খামার গড়ে উঠেছে। লোকজন সেখানে গিয়ে গরু পছন্দ করে কিনে নেন। কেউ বা ঘরে বসে সেই অনলাইনে ছবি দেখে গরু কিনেন।
আগে সবাই-ই বাসার আশেপাশে পশু কোরবানি দিতেন। এখন সিলেট সিটি কর্পোরেশন চেষ্টা করছে, একটি নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানি করতে। প্রচেষ্টাটি পুরোপুরি সফল না হলেও অনেকে নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানি দেবার চেষ্টা করছেন। এতে করে পশুর বর্জ্য দ্রুত পরিস্কার করা সম্ভব হয়।
অনেকে একা একটি পশু কিনে কোরবানি দেন, আবার কয়েকজন মিলেও একটি গরু কোরবানি দেবার প্রচলন আছে। কোরবানির গরুকে জবাই করার জন্যে মাটিতে ফেলা খুব শক্ত কাজ। ভীষণ বেগ পেতে হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো প্রফেশনাল কসাইরা একটি পা দড়ি দিয়ে বেঁধে কেমন কৌশলে ঝটপট গরুকে মাটিতে ফেলে দিতো। তাদের গরুর চামড়া ছড়ানোটাও ছিলো দেখার মতো। পাতলা একটি ছুরি দিয়ে দ্রুত চামড়া ছিলে ফেলতো তারা। চামড়ার কোথাও কাটতো না। ঝটপট বিশাল গরুকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো। তারপর সবাই মিলে মাংস কাটা শুরু হতো। আমিও বড়দের সাথে মাংস কাটতে লেগে যেতাম। কোরবানির ঈদে নাস্তা-টাস্তা কম বানানো হতো। বেড়ানোও হতো কম। সবাই ব্যস্ত থাকতেন মাংস নিয়ে, তবে মাংস কাটতে গিয়ে প্রায়ই আমার হাত কাটতো।
ঈদ এখনো আসে, ঈদ যায়। এখন ঈদ মানে কারো কাছে বিশাল বিশাল ঈদ সংখ্যা, টিভির অনুষ্ঠান, নতুন ফ্যাশনের কাপড়, নগরীর বিশাল বিশাল শপিং মলে কেনাকাটা, ঈদে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, হাটবাজার, গরিবের না পাওয়া কতো কী। তবে প্রায় সবাই হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন, কোরবানিসহ আমাদের সকল ধর্মীয় কাজের মুল উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি।
সেকালের ঈদ নিয়ে এখন মনে হয় আমাদের শৈশবের ঈদে না পাওয়ার বিষয় খুবই কম ছিলো। নানাভাবে মনকে বুঝিয়ে আমরা আনন্দময় করে তুলতাম ঈদ। আজো কামনা করি ঈদ আমাদের জন্যে হোক আনন্দের। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসার মাধ্যমে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে।
লেখক : গল্পকার, সাংবাদিক, সংগঠক।




