বিস্মৃতপ্রায় এক রাজনীতিকের নাম শহীদ আলি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ২:৫৩:১৮ অপরাহ্ন
নজরুল ইসলাম বাসন :
গত ৫৪ বছর ধরে সিলেটের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে খুব একটা বড় কাজ যে হয়নি, তা নয়। তবে বৃহত্তর সিলেট, এখন যা সিলেট বিভাগ, এই বিভাগের অনেক রাজনৈতিক নেতার ইতিহাস আমরা জানি না। আমাদের জানার সুযোগও কম। কারণ বিভাজনের রাজনীতির করালগ্রাসে বিলুপ্ত হয়েছে সিলেটের বর্নাঢ্য রাজনৈতিক নেতাদের ইতিহাস।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে পাকিস্তানের রাজনীতি আর ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশের রাজনীতির যে চিত্র, তাতে অনেক ব্যবধান। ইতিহাসের করালগ্রাসে হারিয়ে গেছেন অনেক তারকা রাজনীতিবিদ। মরহুম শহীদ আলি ছিলেন এমন এক আদর্শিক রাজনীতির ধারক ও বাহক, যা বিশ্বাস করেছেন, তাই তিনি তার রাজনীতিতে জড়িত করেছেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে রাজনীতি করেছেন, প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানকে সমর্থন না করে কাউন্সিল মুসলিম লীগ যোগ দিয়েছেন, তিনি ঢাকাকে ফেডারেল রাজধানী করার দাবী জানিয়েছিলেন, তা সে সময়কার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

মরহুম এডভোকেট শহীদ আলির মতো একজন তারকা রাজনীতিবিদের সাথে রাজনীতি করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। তিনি ছিলেন তখন পরিপক্ষ রাজনীতিবিদ, আর আমি মাঠের ছাত্রকর্মী। সিলেট বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এডভোকেট শহীদ আলি এবং আমি ছিলাম জেলা ছাত্রদলের প্রথম আহ্বায়ক এবং পরে আমাকে সভাপতির ও আলমগীর কুমকুমকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি এই দায়িত্ব থাকাকালে মরহুম আইনজীবী শহীদ আলির সংস্পর্শে এসেছি।
আমি তার নিকট থেকে শুনেছি অনেক গল্প, যার সব কথা এখানে লেখা সম্ভব নয়, স্থানাভাবে। পাকিস্তান মুসলিম লীগ ভাগ করেন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সবুর খান, আজমল আলি চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মোনেম খানের মত নেতারা আয়ুবের সাথে হাত মেলান। কিন্তু এডভোকেট শহীদ আলি সেই পথে যাননি। তিনি পাকিস্তানের মিয়া মমতাজ দৌলতানার সাথেই ছিলেন। ১৯৭০ সালের দিকে একবার মিয়া মমতাজ দৌলতানা পদত্যাগ করলে এডভোকেট শহীদ আলি দলের হাল ধরেন। এ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে সিলেটের কোনো নেতা একটি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হয়েছিলেন, এমন নজির নেই।

তিনি ছিলেন একজন জাতীয় নেতা। তবে সিলেটে বসবাস করার কারণে সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমানের মতো তার পরিচিতি গড়ে উঠেনি। ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন, তখন সবুর খান ও শাহ আজিজ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন জাতীয়তাবাদী দল গঠন করলেন, তখন সবুর খান বিএনপিতে যোগ দিলেন না, তিনি আলাদাভাবে মুসলিম লীগ নিয়ে ইলেকশন করলেন। মুসলিম লীগের একটি অংশের এ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হলেন এডভোকেট শহীদ আলি এবং শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন দলের সেক্রেটারি, তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ বিএনপিতে যোগ দেয়।
কূটকৌশলের নায়ক শাহ আজিজুর রহমান ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ আসন থেকে এডভোকেট শহীদ আলি যাতে নমিনেশন না পান, সে জন্যে শাহ আজিজুর রহমান কূটকৌশলের আশ্রয় নেন এবং দেওয়ান তৈমুর রাজাকে নমিনেশন পাইয়ে দেন। নির্বাচনের পরে তৈমুর রাজাকে কয়েক মাসের জন্যে রেলওয়ে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল।
এডভোকেট শহীদ আলির পদ পদবির প্রতি মোহ ছিল না। সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটিতে এডভোকেট শহীদ আলিকে সভাপতি ও মরহুম হারিছ চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি কখনো পদ-পদবী ব্যবহার করে সুযোগ নেননি। তিনি কোনো স্বজনপ্রীতি করেছেন বলে জানা যায়নি। তার পুত্র কন্যারা সবাই খুব উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে চাকুরি করেছেন, ইউকে এবং ইউএসএ থাকেন। পিতার রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে তারাও কোনো সুবিধা নেওয়ার পক্ষে নন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এডভোকেট শহীদ আলি বিএনপিতেই ছিলেন। উচ্চশিক্ষিত সজ্জন এই রাজনীতিবিদ ছিলেন পেশাদার আইনজীবী, পিপি হিসাবেব দায়িত্ব পালন করেছিলেন বহু যুগ আগে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তার রাজনীতি ছিল পরিচ্ছন্ন। কোনো দুর্নীতির কালিমা তাকে ছুতে পারেনি। পরপারে তিনি যেন শান্তিতে থাকেন, ভালো থাকেন, মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা।
লেখক : অতিথি সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক।



