মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘মহারাসলীলা’ আজ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৫২:২৩ অপরাহ্ন
সুনীল সিংহ
মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা আজ সোমবার। প্রতিবছর লক্ষ্মীপূজার পরের পূর্ণিমা তিথিতে এই মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাসলীলা উপলক্ষে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা উপলক্ষে প্রস্তুত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামন্ডপ (তিন মন্ডপ) ও আদমপুরের সানা ঠাকুর মন্দির, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার উত্তর ছয়শ্রী (বেন্দারিয়া) গ্রাম এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাঁও (ভরম) মণিপুরী পাড়ার শ্রী শ্রী জগন্নাথ জিউর আখড়া।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামন্ডপে (তিন মন্ডপ) মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা ১৮১তম বার্ষিকী, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার উত্তর ছয়শ্রী (বেন্দারিয়া) গ্রামে শ্রীশ্রী মহাপ্রভু জিউর মন্দিরে ৮৬তম বার্ষিকী এবং সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাঁও (ভরম) মণিপুরী পাড়ার শ্রীশ্রী জগন্নাথ জিউর আখড়ায়ও রাস উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
এছাড়া, মৈতৈ মণিপুরীরা কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানা ঠাকুর মন্দির প্রাঙ্গণে ৩৮তম রাস উৎসবের আয়োজন করেছেন।
মহারাসলীলা দুই ভাগে বিভক্ত- গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা। গোষ্ঠলীলায় শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু (গরু) চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখোয়াল’ বলা হয়ে থাকে।
রাসলীলায় অভিনীত হয় ‘গোপীনৃত্য’। গোপীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলাকেই এই পর্বে অনুকরণ করা হয়। রাসলীলাকে ‘পূর্ণিমা রাস’ও বলা হয়ে থাকে। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠেন একদিনের এই আনন্দে। রাসোৎসবকে ঘিরে কমলগঞ্জের মাধবপুর ও আদমপুরে, চুনারুঘাট উপজেলার উত্তর ছয়শ্রী (বেন্দারিয়া) গ্রামে ও কোম্পানীগঞ্জের মাঝেরগাঁও (ভরম) মণিপুরী পাড়ার মন্ডপগুলো সাজানো হয়েছে সাদা কাগজের নকশার সুনিপুণ কারুকাজে। আলোকসজ্জাও করা হয়েছে। মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। রাত ভর চাঁদের আলোয় মায়াবী জোৎসনায় নূপুরের সিঞ্চনে মুদ্রা তুলবে সুবর্ণ কঙ্কন পরিহিতা রাধা ও গোপিনী রূপের মণিপুরী তরুণীরা। সুরের আবেশে মাতাল হয়ে উঠবে এসব স্থানের প্রকৃতি ও জনমানুষ।
মহারাসলীলার মূল উপস্থাপনা শুরু হবে সকাল ১১টায় ‘গোষ্ঠলীলা (রাখাল) নৃত্য’ দিয়ে, গোধূলীলগ্ন পর্যন্ত। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ উৎসব রাস নৃত্য।
রাসনৃত্য বছরের বিভিন্ন সময়ে নবনব সাজ-সজ্জায় অনুষ্ঠিত হয়। যেমন-
মহারাস : কার্তিক পূর্ণিমাতে এই রাস অনুষ্ঠিত হয়। ভাগবত পুরাণে বর্ণিত রাসপঞ্চাধ্যায় অবলম্বনে কৃষ্ণের অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, মন্ডল সাজন, গোপীগণের রাগালাপ, ভঙ্গী, কৃষ্ণনর্তন, রাধা নর্তন, গোপিনীনর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান, শ্রীকৃষ্ণের প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি (প্রার্থনা ও আরতি), গৃহগমন অংশ নৃত্যগীতের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়।
বসন্ত রাস : চৈত্র পূর্ণিমাতে এই রাস অনুষ্ঠিত হয়। এই রাসে হোলিখেলা, শ্রীকৃষ্ণ ও চন্দ্রবলীর নৃত্য, রাধার ঈর্ষা, ক্রোধ এবং প্রস্থান, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক রাধার অনুসন্ধান, ললিতা ও বিশাখাসহ শ্রীকৃষ্ণের রাধার গুঞ্জে গমন, মানভঞ্জন, ভঙ্গী, গোপীগণের নৃত্য, পুষ্পাঞ্জলি এবং গৃহগমন।
কুঞ্জরাস : এই রাস অনুষ্ঠিত হয় আশ্বিন মাসের অষ্টম দিবসে। এই রাসে রাধা, কৃষ্ণ ও সখীদের অভিসার এবং কুঞ্জে আগমন অংশ নৃত্য-গীত ও অভিনয় দ্বারা সম্পন্ন হয়।
গোষ্ঠরাস বা গোপরাস : এই রাস অনুষ্ঠিত হয় কার্তিক মাসে। এই রাসের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় নেই। রাসনৃত্যে এই অংশ যুক্ত চৈতন্যদেবের অনুসারীদের দ্বারা। এই রাসে শ্রীচৈতন্যের বন্দনা গীত পরিবেশিত হয়। এরপর শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা নৃত্য-গীত সহযোগে অভিনীত হয়।
উদুখল রাস : এই রাসও কার্তিক মাসে হয়। এই রাসেও শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা নৃত্য-গীত সহযোগে অভিনীত হয়।
নিত্যরাস : যে কোনো বৈষ্ণব-অনুষ্ঠানে এই রাস হয়। এই অংশে মূলত রাধাকৃষ্ণের অভিসার নৃত্য-গীত সহযোগে অভিনীত হয়।
মণিপুরী বিশিষ্টজন সূত্রে জানা যায়, ১৭৭৯ সালে ভারতবর্ষের মণিপুর রাজ্যের মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেছিলেন তাই রাসনৃত্য। মণিপুরীরা এর ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই ১৮৪২ সাল থেকে কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামন্ডপে উদযাপন করে আসছে এ রাসোৎসব। এই উৎসবে মৃদঙ্গ, করতাল, বাঁশি ও শঙ্খধ্বনির সাথে গানের মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলা প্রদর্শিত হয়।
আর ১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে সিলেটের মাছিমপুরের মণিপুরীপাড়ার মেয়েদের পরিবেশিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু মাছিমপুরে দেখা রাসনৃত্যের কমলগঞ্জস্থ নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা।
উল্লেখ্য, মণিপুরী ও নৃত্যকলা শুধু বুহত্তর সিলেট নয়, গোটা ভারত উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।