পাঠ্যবইয়ে ডারউইনের মতবাদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:০৪:২০ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন On the origin of specier by the means of Natural selection নামক একটি বই প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সকল প্রাণী কিছু কমন পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। একটি প্রাণী ক্রমাগত Adaptation বা অভিযোজনের ফলে আপন পরিবেশের জন্য বিশেষায়িত হতে হতে এক সময় নতুন একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। বিবর্তনের এ প্রক্রিয়াটি Natural selection বা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে হয়। ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২খ্রি:) এর তথ্য মতে, গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও মানুষ একটি বানর জাতীয় (Ape-like) সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে পরিবেশ অনুযায়ী ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে। মোট কথা ডারউইন এর ভ্রান্ত মতবাদ হলো, ‘বানর থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে, বানর থেকেই মানুষ’। ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদ মেনে নিলে মানুষ আর মানুষ থাকতে পারে না।
ডারউইনের মতবাদটি একজন বিবেকবান কখনও মেনে নিতে পারে না। বানর থেকেই যদি মানুষ হয় তাহলে তার মধ্যে মনুষ্যত্ব আসবে কোথা থেকে? আর এ বিষয়টি (বানর থেকে মানুষ) যদি পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত করে কোমলমতি শিশুদের শিখানো হয় তাহলে কোমলমতি শিশুরা তো মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই শিখবে না। বানর তো হচ্ছে একটি পশু। মানুষের উদ্ভব যদি বানর-পশু থেকে হয় তাহলে সেই মানুষ তো সর্বদা পশুর মতই আচরণ করবে- সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মত আচরণ করবে না। দুঃখজনক বাস্তব ঘটনা হলো, ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদ ‘বানর থেকেই মানুষ’ এ বিষয়টি আজ মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হয়েছে- ‘বানর থেকেই মানুষ’।
নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে। মাদ্রাসার বইগুলোতে যেসব বিতর্কিত পাঠ উপস্থাপন করা হয়েছে (বিশেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে) তা অত্যন্ত দুঃখজনক। ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে বিবর্তনবাদ, প্রাচীন সভ্যতার নামে মূর্তি, হিজাববিহীন মেয়েদের ছবি, গান-বাজনা, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, মোবাইল ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নামে অশ্লীল ছবি, কুকুরের ছবি, সভ্যতার নামে উলঙ্গ ও অর্ধউলঙ্গ ছবি ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে মাদ্রাসার বইয়ে। দেড় হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্য, নীতি-নৈতিকতা, কবি-সাহিত্যিকদের অবদানের কোনো উল্লেখ নেই বললেই চলে সেই মাদ্রাসার বইয়ে। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও কালচারের আলোচনা খুবই কম। বইগুলোতে তিন শতাধিক মেয়ের ছবি পর্দাহীনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিজ্ঞান বইয়ে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে তাদের লজ্জাস্থানের পরিচয় দেয়া হয়েছে এবং ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন অঙ্গের বর্ণনা দিয়ে মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নির্লজ্জ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ইংরেজি বইয়ে ১২টি কুকুর ও ১৪টি নেকড়ে বাঘের ছবি দেয়া হয়েছে, যা ইউরোপীয় কুকুর সংস্কৃতিরই অংশ বিশেষ। সাহিত্য হিসেবে চরিত্র সৃষ্টি করার ব্যবস্থা নেই আজকে মাদ্রাসার বইয়ে। ‘জীবন ও জীবিকা’ বইয়ে পূজা, প্রণাম ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদেরকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই বইগুলোতে মেয়েদেরকে ফুটবল খেলা, অনলাইনে কার্টুন দেখার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে ডারউইনের মতবাদ (বানর থেকেই মানুষ) উপস্থাপন করে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদেরকে মনুষ্যত্বহীন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পাঠ্যবই থাকবে এমন, যাতে শিক্ষার্থীরা বই পাঠ করে চরিত্র গঠন করতে পারে, কোনটি ভালো কোনটি মন্দ তা সঠিকভাবে বুঝতে পারে এবং জীবনে তা প্রয়োজনের সময় প্রয়োগ করতে পারে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়ের এ যুগে চরিত্র গঠনে সহায়ক বিষয়গুলো পাঠ্য পুস্তকে উপস্থাপিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য পুস্তকে উপস্থাপন করা হয়েছে চরিত্র বিধ্বংসী সেই বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদ। ডারউইনের সেই মতবাদ ‘বানর থেকেই মানুষ’- এ কথাটি মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে অত্যন্ত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে শিক্ষার্থীদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ অনুযায়ী প্রণীত এবং ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে দাখিল ষষ্ঠ শ্রেণির নির্ধারিত পাঠ্যবই ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) এর ২১ পৃষ্ঠায় ‘মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে- ‘উপরের প্রশ্নটা শুনলেই একটু অবাক হতে পারো। মানুষ আর সমাজ এলো- মানে কী? আমরা মানুষ তো এরকমই মানুষ। সবসময়। ইতিহাস কিন্তু সেই কথা বলে না। মানুষ ও সমাজের ধীরে ধীরে বদল হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের দৈহিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন, কথা বলতে পারা বা লিখতে পারা, চাষাবাদ করা, শিকার করা ইত্যাদি সবকিছুই অনেক, অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। সেই পরিবর্তনের ফলেই আজ আমরা মানুষ। এই ইতিহাস কিন্তু অনেক লম্বা, লক্ষ লক্ষ বছরের। মানুষ নিয়ে আলাপ প্রসঙ্গে আমরা শুরু করতে পারি আনুমানিক ৩.৩ মিলিয়ন (প্রায় ৩৩ লক্ষ) বছর আগে থেকে। যখন মানুষের যাত্রা শুরু হলো। সেই সময়ে কিন্তু মানুষ ছিল না। অনেকে বলেন, মানুষের উদ্ভব হয়েছে নাকি বানর থেকে (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, অনুসন্ধানী পাঠ, ষষ্ঠ শ্রেণি, প্রকাশকাল ডিসেম্বর-২০২২)। শুধু তাই নয়, মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদ ‘বানর থেকেই মানুষ’- তা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান- অনুশীলন বই, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর-২০২২, পাঠ্যাংশ খুঁজে দেখি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস: পৃষ্ঠা-১১৪, বিভিন্ন সময়ের মানুষ: পৃষ্ঠা- ১১৫)
‘বানর থেকেই মানুষ’- এটা ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদ। একজন বিবেকবান কখনও এ ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী হতে পারে না। এই ভ্রান্ত মতবাদটি আজ স্থান পেয়েছে মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। মুসলমানদের ইমান-আকীদা ও চরিত্রহীন করার জন্যই এই ভ্রান্ত মতবাদের স্থান দেয়া হয়েছে মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে। এ ব্যাপারে আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে এবং ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। বানর থেকে কখনও মানুষ হতে পারে না। ‘মাটি থেকেই মানুষ, মানুষ থেকেই মানুষ’- এটাই চিরসত্য কথা। মাদ্রাসার পাঠ্যবই থেকে ডারউইনের ভ্রান্ত মতবাদ বিষয়ক অধ্যায়টি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।