মাদক ও আত্মহনন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ৭:৪৩:৫৭ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
মাদকের নেশা কেবল আত্মঘাতী নয়, সমাজ, দেশ, মনুষ্যত্ব সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী ডেকে আনছে বিপুল বিপর্যয়। ব্যক্তিজীবনে যেমন ড্রাগ ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, সম্পদ, মানসম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি নষ্ট করে ব্যক্তিকে। করে তোলে সমাজের ঘৃণা ও নিন্দার একশেষ তেমনি সমাজ জীবনেও নেমে আসে অস্বাস্থ্য, অলসতা, অকর্মণ্যতা এবং সামাজিক অপরাধের সীমাহীন নিষ্ঠুরতা। ধসে যায় তার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, সামাজিক মূল্যবোধের মতো চরম গুণগুলি। আজকের পৃথিবীতে এই ব্যাধি পরিব্যাপ্ত দেশ থেকে দেশান্তরে। এই নেশার উপর ভর করে একদল নেশার কারবারি আজ মানুষ কর্তৃক মানুষ মারার নেশায় বুঁদ হয়ে ধ্বংস করতে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বজনীন মূল্যবোধ, প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-ভক্তি রসধারাকে সীমাহীন আত্মঘাতী নিষ্ঠুরতায়। নেশার নেশায় বুঁদ এসব নেশার কারবারিরা আজ নেশার বাণিজ্য সম্ভারে মেতে মানুষের মারণ নেশায় ড্রাগ পাচার এবং ড্রাগের অর্থে অস্ত্র হাতে বিশ্বকে করে তুলেছে সন্ত্রস্ত। তাই ড্রাগ কেবল ব্যক্তিজীবন নয়, সমাজ, সমষ্টি এবং বিশ্বজীবনেও ডেকে আনছে বিপুল বিপর্যয়।
বিশ্বের প্রায় সবক’টি মহাদেশেই এই অবৈধ ড্রাগ উৎপাদিত হয় কিংবা ব্যবহৃত হয় যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশেও এই বিষয়ে খুব একটা পিছিয়ে নয়। আফিম ও ভাং-এর প্রচলন সুপ্রাচীন। বিগত তিন দশকে হেরোইন, এম্ফিটামিন, কোকেন ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং নানা ভেষজ ওষুধ উন্নত নগরগুলোতে প্রবেশ করেছে যা অবৈধ ড্রাগের ভয়াবহতাকে আরও উসকে দিয়েছে। এক সময় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল অর্থাৎ মায়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড কিংবা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অর্থাৎ আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান থেকে অবৈধ ড্রাগ, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শুধু পাচার হতো কিন্তু আজ এই চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের খবরে জানা যায় সরকারের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের একটি প্রতিবেদনে ৭০ লক্ষ মানুষের নেশাসক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যাটি ক্রমশ শহরগুলি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার এবং জাতিসংঘের ড্রাগ ও অপরাধ নিবারক সংস্থা যৌথভাবে অবৈধ ড্রাগ সেবন সংক্রান্ত একটি পর্যবেক্ষণ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে ১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোরদের মধ্যে অ্যালকোহল ২১.৪ শতাংশ, ভাং ৩ শতাংশ, আফিম ০.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য অবৈধ ড্রাগ ৩.৬ শতাংশ সেবনের প্রবণতা, দেখা গেছে। অবৈধ ড্রাগ সেবনের এই প্রবণতা সারা দেশে এক রকম নয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মদ্যপান সবচেয়ে আম ঘটনা। ভাং খাওয়ার প্রবণতায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে টেক্কা দিচ্ছে পূর্বাঞ্চলও ব্যাপক পরিমাণে আফিম খাওয়ার প্রবণতা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলেও লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশে নেশা করার আরেকটি নতুন উপাদান হিসেবে ভেষজ ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কিন্তু ব্যথা কমানোর ওষুধ, কোডেইন দিয়ে তৈরি কফ সিরাপ, ঘুমের ওষুধ, কিছু অ্যান্টিহিস্টামিনিক এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। নেশা করার একটি ভয়াবহ মাধ্যম হচ্ছে ইঞ্জেকশন। সম্প্রতি একটি রিপোর্ট এ-বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হেরোইন, বুপ্রেনরফিন এবং প্রোপক্সিফেন-এর মিশ্রণ ইঞ্জেকশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তা ছাড়া, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রোক্সিন নামক ওষুধও ইঞ্জেকশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একটি ইঞ্জেকশানের বহু ব্যবহারের ফলে নেশাসক্তদের মধ্যে এইচআইভি-এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রচণ্ড বেড়ে যায়।
নেশায় আসক্ত হওয়ার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। কিন্তু এই কারণ যাই হোক না কেন, নেশা সমাজের প্রধান পাঁচটি অংশকে অর্থনৈতিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অংশগুলি হচ্ছে স্বাস্থ্য, মানুষের নিরাপত্তা, অপরাধ, উৎপাদন এবং সরকারি কার্যপ্রণালী। প্রথমেই আলোচনা করা যাক স্বাস্থ্য সম্পর্কে।
এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৫ লক্ষ লোক হিরোইন, ভাং , ইয়াবা ও কোকেনের নেশাগ্রস্ততার কারণে চিকিৎসাধীন এবং এতে বছরে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হচ্ছে। কিন্তু সব জায়গায় এই চিকিৎসার -সুযোগ সমভাবে উপলব্ধ নয়। আফ্রিকাতে প্রতি ১৮ জন নেশাসক্ত লোকের মধ্যে ১ জন চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। আবার লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে প্রতি ১১ জন লোকের মধ্যে ১জন চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন যেখানে উত্তর আমেরিকায় প্রতি ৩ জন নেশাসক্ত লোকের মধ্যে ১ জন চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। বিশ্বের প্রতিটি ড্রাগ আসক্ত লোক যদি চিকিৎসার সুযোগ পেতেন তবে এই খরচের পরিমাণ হতো ২০০ থেকে ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অন্য এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১৫ থেকে ৬৪ বছরের লোকদের মধ্যে ড্রাগজনিত কারণে মৃত্যুর হার ০.৫ থেকে ১.৩ শতাংশ। ইউরোপে এই মৃত্যুর গড়পড়তা বয়স ৩০ বছর। ইঞ্জেকশন নিয়ে যারা নেশা করে এমন ১৪০ লক্ষ লোকের মধ্যে ১৬ লক্ষ লোক এইচআইভি, ৭২ লক্ষ হেপাটাইটিস-সি ও ১২ লক্ষ লোক হেপাটাইটিস-বি-তে ভুগছে। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ড্রাগজনিত কারণে অসুস্থতার মাত্রা ক্রমশ বেড়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। মৃত্যুর কারণের ক্রমানুসারে তামাক দ্বিতীয়, অ্যালকোহল তৃতীয় এবং অবৈধ ড্রাগ সেবন ১৯তম স্থানে রয়েছে। ১৫ থেকে ৪৯ বছরের লোকদের মৃত্যুর কারণে ক্রমে ড্রাগ সেবন ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।
নেশাগ্রস্ত লোকেরা যে শুধু নিজের ক্ষতি করে এমন নয়, পারিপার্শ্বিক মানুষের নিরাপত্তাও সঙ্কটাপূর্ণ হয়ে পড়ে। নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালালে পথ দুর্ঘটনায় চালকের যেমন ক্ষতি হয় পথযাত্রীদেরও সমান খেসারত দিতে হয়। একটি গবেষণায় জানা গেছে, ভাং খেয়ে গাড়ি চালালে পথ দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ১.৫ গুণ এবং কোকেন ও ব্যাঞ্জোডায়াজিপাইনের ক্ষেত্রে ২ থেকে ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়। এম্ফিটামিন ড্রাগে এই সম্ভাবনা ৫ থেকে ৩০ গুণ এবং মদের সঙ্গে অন্য ড্রাগ মিশিয়ে খেলে ২০ থেকে ২০০ গুণ বৃদ্ধি পায়।
আফিম ও ভাং-এর অবৈধ চাষের ফলে ব্যাপকভাবে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে এবং এর জলজ্যান্ত উদাহরণ বলিভিয়া, কলম্বিয়া ও পেরু। এই অবৈধ চাষ একদিকে বনভূমি ধ্বংস করছে অন্যদিকে চাষযোগ্য জমির পরিমাণও কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবৈধ চাষ জমি ও পারিপার্শ্বিক পানিকে দূষিত করে বন্যপ্রাণী ও মানুষের জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলছে।
অবৈধ ড্রাগের সাথে অপরাধের তিনটি যোগসূত্র রয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ সেবনেই অপরাধ সংঘটিত হয়। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডোমিনিকা, সেন্ট কিটস ও নেভিস এবং সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রিনাডিন-এর ৫৫ শতাংশ অপরাধীরা অপরাধের সময় নেশাগ্রস্ত ছিলেন।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে টাকার উন্মাদনার জন্যই অপরাধ সংঘটিত হয়। এই টাকার মাধ্যমে তারা তাদের প্রয়োজনীয় ড্রাগের চাহিদার জোগান দেয়। তৃতীয় ক্ষেত্রে অবৈধ ড্রাগ বাণিজ্যের এলাকা নির্ধারণ অথবা কেনাবেচার সময় সৃষ্ট সমস্যার সুরাহা করতে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত হয়। বিগত দশবছর ধরে লাতিন আমেরিকায় বিশেষ করে গুয়াতেমালা ও মেক্সিকোতে এই ঘটনা খুবই সাধারণ। অস্ট্রেলিয়ার ড্রাগ সংক্রান্ত অপরাধের জন্য বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আমেরিকাতে প্রায় ৬১ বিলিয়ন ডলার।
নেশা মানুষের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত করে তোলে। মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবন রোগীর মানসিক অবসাদ ঘটায় এবং হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি-এইডস ও যক্ষ্মার মতো ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। ঘন ঘন রোগে আক্রান্ত হওয়া কিংবা মারা যাওয়া উভয় ক্ষেত্রেই দেশের প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।