সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
সংসদ সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মে ২০২৩, ৮:৩২:১৭ অপরাহ্ন
# যারা আমাদের স্যাংশন দেবে তাদের থেকে কোন কিছু কেনাকাটা করবো না
# দেশে ৩১ দশমিক ২২ বিলিয়ন রিজার্ভ রয়েছে, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই
ডাক ডেস্ক : সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ সদস্যরা চাইলে তাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
গতকাল সোমবার বিকেলে গণভবনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তার ইতিবাচক অবস্থানের কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। যেহেতু বিএনপির বর্তমান সংসদে কোন প্রতিনিধিত্ব নেই, ফলে নির্বাচনকালীন এমন সরকার গঠিত হলেও তাদের (বিএনপি) স্থান পাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা পশ্চিমা গণতন্ত্র ফলো করি। ব্রিটেনে কীভাবে নির্বাচন হয়, তারা কীভাবে করে, আমরা সেইভাবে করব। আমরা এইটুকু উদারতা দেখাতে পারি, সংসদে যেসব (বিরোধীদলীয়) সংসদ সদস্য আছে, তাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে, আমরা নিতে রাজি আছি। এমনকি ২০১৪ সালে খালেদা জিয়াকেও আমি এ আহ্বান করেছিলাম, তিনি আসেননি।
সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত বছরের ডিসেম্বরে বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন। তাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন তারা (বিএনপি) সংসদে নেই। তাই তাদের সম্পর্কে চিন্তা করার কিছু নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার হঠাবে। আমরা তো তাদের (বিএনপি) কিছু বলছি না। আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম তখন আমাদের নামতে দিয়েছে? হামলা করেছে, ২১ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করেছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে। নির্বাচন ঠেকাতে ৫০০ স্কুল পুড়িয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার লোক ও ৩৮০০ গাড়ি পুড়িয়েছে। ২৭টি রেল পুড়িয়েছে। ৭০টি সরকারি অফিস পুড়িয়েছে। আন্দোলন করুক তারা কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি জ্বালাও-পোড়াও কিছু করতে যায়, কোনো মানুষকে যদি আবার পোড়ায় তাহলে ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, মানুষের ক্ষতি আর করতে দেব না। একেকটা পরিবার আজকে কি দুরবস্থায় আছে খোঁজ রাখেন? নিজের সন্তানকে কোলে নিতে পারে না। চেহারা নিয়ে কোথাও যেতে পারে না। কী বীভৎস অবস্থা সৃষ্টি করেছে বিএনপি-জামায়াত।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ২০ দলীয় ঐক্যজোট সিট পেয়েছে মাত্র ২৯টি। তারা আবার বড় বড় কথা বলে। আর দালালি তো আছেই। কার পয়সায় আন্দোলন করছে, কোথা থেকে টাকা পাচ্ছে? বাংলাদেশের মানুষ কি এত অন্ধ হয়ে গেছে, চোখে দেখে না।
তিনি বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা তো লুট করে নিয়েই গেছে, আর কাদের মদদে করছে সেটা একটু খোঁজ নেন। এত লোক নিয়ে আসে আর প্রতিদিন মাইক লাগিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে, এগুলো তো বিনা পয়সায় হচ্ছে না। টাকা মানিলন্ডারিং তো খালেদা জিয়ার দুই পুত্রই করেছে। পাচারকৃত ৪০ কোটি টাকা ফেরত এনেছি। তাদের অনেক নেতার বিদেশের নানা ব্যাংকে পাচারকৃত টাকা আছে, অনেকগুলো জব্দ অবস্থায় আছে। তাদের আবার বড় বড় কথা।
সংলাপ ইস্যুতে দেশে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি আবারও নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আলোচনায় কিসের জন্য ডাকতে যাবো? তাদের ডিমান্ডই তো ঠিক নাই। যুক্তরাজ্যে যারা ছিলেন তখন বৃষ্টি নেমেছিল। আমি ভাবলাম বাংলাদেশের প্রবাসী তারা বৃষ্টিতে ভিজবে তার চেয়ে তাদের ডাকি, কী বলতে চায় শুনি। এখন ঢাকায় বা বাংলাদেশে যারা তাদের যদি বৃষ্টিতে ভেজা শখের মধ্যে থাকে তারা থাকুক।
স্যাংশনের ভয়ে বসে থাকবো কেন? স্যাংশনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কী কারণে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেবে? যাদের দিয়ে (র্যাব) আমরা সন্ত্রাস দমন করলাম, জঙ্গিবাদ দমন করলাম। হলি আর্টিজানের পর বাংলাদেশে আর তেমন কোনও বড় ঘটনা ঘটেনি। কারণ, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গোয়েন্দা নজরদারি এবং আরও কিছু ভালো কাজ করেছে। যার ফলে আর কিছু তেমন হয়নি। এরপরও স্যাংশন কেন? সেটাই আমাদের প্রশ্ন।
তিনি বলেন, আমি তো অর্থ মন্ত্রণালয়কে, কেনাকাটার বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে বলে দিয়েছি। এখন থেকে আমাদের শর্ত থাকবে, যারা আমাদের স্যাংশন দেবে তাদের থেকে আমরা কোন কিছু কেনাকাটা করবো না। পরিষ্কার কথা। এখানে ভয়ের কী আছে? যেটা নিয়ে সমস্যা হয় সেটা আমরা উৎপাদন করে সমাধান করতে পারি। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী যেখানে মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যের অভাব, উন্নত দেশে খাবার কেনা সীমিত করে দেওয়া হচ্ছে, যারা বড়লোক তাদের অসুবিধা নাই, সাধারণ মানুষের তো অনেক অসুবিধা হচ্ছে। সেদিক থেকে আমরা তো আমাদের মানুষকে প্রণোদনা দিয়েছি। রোজার সময় তো মানুষের হাহাকার শোনা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোজার সময় আমরা মানুষকে যথেষ্ট সাহায্য করেছি। আমাদের নেতাকর্মীরা করেছে। তো আমাদের দুশ্চিন্তার কী আছে? কথা নাই, বার্তা নাই, স্যাংশনের ভয় দেখাবে আমরা ভয় পেয়ে বসে থাকবো কেন? আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। যারা আমাদের সপ্তম নৌবহরের ভয় দেখিয়েছিল, আমরা সেটি পার করে বিজয় অর্জন করেছি। সেটি ভুললে চলবে না, আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, এটা সেটা শুনতে হয়।
তিনি বলেন, আমাদের দেশেরই কিছু মানুষই দেশের বদনাম করে। তারা যে দুর্নীতিসহ কত অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সেগুলো আমাদের সাংবাদিকরা খুঁজে বের করে না। সাংবাদিকরা খুঁজলে অনেক তথ্য পাবে। আবার দেশে কিছু লেবার লিডার আছেন- ভালো গাড়িতে চড়ে ভালো খাবার খেয়ে আবার বিদেশে গিয়ে দেশের বদনাম করে আসে। এটাই হলো সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশের মাটি উর্বর, দেশের মানুষ শক্তিশালী। দেশের যুব-তরুণ-মায়েরা সবাই কাজ করেন। সবাই মিলে আমরা নিজেরা উৎপাদন করে নিজেরা খাবো।
রিজার্ভ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার কিছু নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে যে ডলার সংকট আছে তা কেটে যাবে। এ প্রসঙ্গে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে বর্তমানে ৩১ দশমিক ২২ বিলিয়ন রিজার্ভ রয়েছে। ২০০৬ সালে ছিল এক বিলিয়নেরও কম। সুতরাং রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, কোনো দেশে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট। সে হিসাবে আমাদের আরও বেশি রয়েছে। এ জন্য রিজার্ভ কমে যাওয়াকে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে দেখছে না সরকার।
শেখ হাসিনা বলেন, করোনা অতিমারির পর স্যাংশন, কাউন্টার স্যাংশন, যার ফলে আজ সারা বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। পরিবহন পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেছে। যে কারণে ডলার সংকট এখন সমগ্র বিশ্বেই রয়ে গেছে। বিশ্বের উন্নত অনেক দেশ রেশনিং করে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্য বিক্রি করছে। আমাদের এখনও সেই অবস্থা হয়নি। আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি, উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়ছে। আমরা নিজেরা অধিক ফসল ফলিয়ে নিজেরা খাব। কারোর কাছে হাত পাতবো না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, করোনা অতিমারির মধ্যে যেটা হয়েছিল যে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ, বিদেশে যাতায়াত বন্ধ, সবকিছু বন্ধ থাকাতে খরচও আমাদের কম ছিল, ভ্যাকসিন কিনতেই যা ডলার লেগেছিল, বাকি আমরা খুব ভালোভাবে একটা রিজার্ভ রাখতে পেরেছিলাম। কিন্তু এরপর যখন আবার অর্থনীতি উন্মুক্ত হলো, স্বাভাবিকভাবেই সেই সুযোগটা থাকেনি, ডলার খরচ হচ্ছে এবং হবে। তার থেকেও বড় কথা, মানুষকে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিচ্ছি, গ্যাস দিয়ে এখানে ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, বিনিয়োগ হচ্ছে, উৎপাদন বাড়ছে। কাজেই ডলারের ওপর চাপ পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের কাছে পদ্মা বহুমুখী সেতুর একটি পেইন্টিং তুলে দেয়ার বিষয়ে বলেন, পেইন্টিংটা আমরা এ জন্য নিয়ে গেছি যে আমাদের দেশে যে খুব ভালো পেইন্টার আছে, তারা খুব চমৎকার পেইটিং করতে পারেন, সেটা জানানোর জন্য। বিশ্বের কারও যদি পেইন্টিং প্রয়োজন হয়, আমাদের কাছে চাইতে পারবেন। আর পেইটিংয়ের বিষয়বস্তুটা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটা- পদ্মা সেতু। এটাই, আর কিছু না সেখানে।
আ’লীগ দেশের নদী-খালগুলো উদ্ধার করেছে। সামরিক স্বৈরশাসকদের সময়ে ঢাকার নদী-খাল ভরাট করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কিছু উদ্ধার করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারা নদীখেকো তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে মূল মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের প্রধানসহ জ্যেষ্ঠ সম্পাদক-সাংবাদিকরা ছাড়াও এ সময় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দসহ সামরিক- বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন প্রধানন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম।
বক্তব্যের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে যথেষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। আমি নিজে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিয়েছি, নানা নির্দেশনা দিয়েছি। আমরা উপকূলীয় ১৩ জেলায় ৭ হাজার ৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছিলাম। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।