হতাশ সিলেট অঞ্চলের মানুষ
চার বছরেও সুরমা-কুশিয়ারা ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুন ২০২৪, ৪:৫৫:৩৭ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
চার বছরেও আলোর মুখ দেখেনি সুরমা কুশিয়ারা ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প। বাইশের বন্যার পর সিলেটের প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ড্রেজিং নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলেও প্রকল্পটির কাজ শুরু না হওয়ায় হতাশ সিলেট অঞ্চলের মানুষ। অর্থমন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র না পাওয়ায় প্রকল্পটি আটকে আছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
বিআইডব্লিউটিএর সূত্র জানিয়েছে, ৫ বছর মেয়াদি ওই প্রকল্পে এক সঙ্গে ১৮টি নদী খননের কথা রয়েছে। প্রকল্পে সুরমা নদী ৪ দশমিক ৩ মিটার গভীর ও ৯০ মিটার প্রস্থ করে খনন হবে। আর এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের পর থেকে সিলেট অঞ্চলে পর পর কয়েক দফা বন্যায় সিলেট নগরীসহ জেলার অনেক এলাকা প্লাবিত হবার পেছনে সুরমা-কুশিয়ারা ভরাট হওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) আ স ম মাশরেকুল আরেফিন গতকাল শনিবার সিলেটের ডাককে বলেন, সিলেট অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারাসহ মোট ১৮টি নদী ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এ প্রকল্প গ্রহণ করে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকল্পটির অনাপত্তিপত্রের জন্যে অর্থমন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র আসার পরপরই এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। প্ল্যানিং কমিশনের অনুমোদনের পরে একনেকে উত্থাপন এবং পাস করা হবে। পরবর্তীতে বিআইডব্লিউটিএ প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করবে। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা ফিরে আসবে। বিআইডব্লিউটিএর বিশেষজ্ঞ টিম সরেজমিন স্টাডি করার পরে প্রকল্পটি প্রস্তুত করা হয়।
সম্প্রতি সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে সিলেটে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, সুরমা-কুশিয়ারাসহ সিলেট অঞ্চলের ছোট-বড় নদ-নদীসমূহ খননের একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই ড্রেজিং শুরু হবে। নদ-নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে সারাদেশে ৯টি ড্রেজিং স্টেশন স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। ড্রেজিংকে একটি ব্যয়বহুল কাজ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ড্রেজিংয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়। উজানের পানির সাথে বিপুল পরিমাণ পলিমাটিও আসে। যে কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। যে কারণে দুই বছর পর পর নদী ড্রেজিং করতে হয়। তলদেশে প্লাস্টিক থাকায় সুরমা নদীতে চলমান ড্রেজিং ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম এ প্রসঙ্গে বলেন, নদী ড্রেজিং প্রকল্প হলো ডাকাতির মতো। এর কোনো হদিস মিলে না-কোনো কুল কিনারা নেই। এই যেমন সুরমা খননের নামে ৫০ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেল। সুরমা-কুশিয়ারাসহ সকল নদীর তলদেশে খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। এটা যেভাবেই হোক করতেই হবে। কিন্তু, নদী ড্রেজিং প্রকল্পের বিস্তারিত যেন জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়। যাতে করে জনসাধারণ জানতে পারেন, কোন নদী কত টাকায় খনন কাজ হচ্ছে। বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয় করে একটি তদারকি কমিটিও করতে হবে। নদী খননের নামে যাতে লুটপাট না হয় সেদিকে কঠোরভাবে নজরদারি থাকতে হবে।
বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদী, কুশিয়ারা নদী, কালনী নদী, যাদুকাটা নদী, রক্তি নদী, বৌলাই নদী, মনু নদী, পুরাংগী নদী, জুমনাল খাল নদী, খোয়াই নদী, সুতাং নদী, বেলেশ্বরি খাল নদী, তিতাস নদী, পাগলা নদী, বুড়ি নদী, মোগড়া নদী, কংশ নদী ও আপার মেঘনা নদী খননের লক্ষ্যে ২০২০ সালে বিআইডব্লিউটি’র বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা সরেজমিনে স্টাডি করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করেন। এরপর ২০২১ সালে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি সংশোধন করে দিতে কিছু নোট দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ-তে ফেরত পাঠায়। ২০২২ সালের শুরুর দিকে সংশোধন করে পুনরায় প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে আবার প্রকল্পটি সংশোধন করতে বিআইডব্লিউটিএতে ফেরত আসে। এরপরে আবারও বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পটি তৈরি করে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অনাপত্তিপত্রের জন্যে অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠান। বর্তমানে প্রকল্পটি মতামতসহ ছাড়পত্রের জন্যে অর্থমন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র পেলে প্রকল্পটি দ্রুত পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। এরপর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি পাশ করার জন্যে একনেকে উত্থাপন করবে।
সিলেটের জকিগঞ্জের সুরমা নদী ও কুশিয়ারা নদীর উৎস মুখ থেকে খনন কাজ শুরু করে আশুগঞ্জের আপার মেঘনা নদী পর্যন্ত খনন কাজ করা হবে। বর্তমানে আশুগঞ্জে প্রতি বছর বাংলাদেশ-ভারতের প্রটোকল অনুযায়ী ৮ ফুট গভীর ও ৩০ মিটার চওড়া করে খনন কাজ করা হয়। ভারত সরকারের খরচে আশুগঞ্জে বর্তমানে খনন কাজ করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ’র প্রকল্প অনুমোদন হলে ৩০ মিটারের স্থলে নদীর প্রস্থ ৭০ মিটার চওড়া করা হবে। কেবল নদী খননই নয়, নদীতে মোট ৫৬টি ঘাটও নির্মাণ করা হবে। ৮টি কার্গো ঘাট, ২৮টি লঞ্চ ঘাট ও ২০টি খেয়াঘাট নির্মাণ করবে বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়াও নির্মাণ করা হবে ১৫টি স্লুইস গেইট।
প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বিআইডব্লিউটিএর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে মোট ৫ বছরে দু’টি ধাপে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। প্রথম দুই বছর হবে ক্যাপিটাল ড্রেজিং। ১৮টি নদীর যে সকল জায়গা ভরাট হয়ে গেছে-প্রথম দুই বছরে সে সকল জায়গা খনন করে পুরোপুরি ক্লিয়ার (পরিষ্কার) করে দেয়া হবে। পরবর্তী তিন বছর হবে সংরক্ষণ। পরের ৩ বছরে যে সকল জায়গায় নতুন করে চর পড়বে সেগুলো আবারও খনন করা হবে। ৯০ মিটার প্রস্থ ও ৪ দশমিক ৩ মিটার বা ১৪ ফুট গভীর করে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন করা হবে। ১৮টি নদীর যেখানে বর্তমানে মালবাহী নৌকা চলাচল করতে পারে এখানে এতো গভীর করে খনন করা হবে না। সার্ভে অনুযায়ী যেখানে যে রকম খনন করা প্রয়োজন; সেখানে সে অনুযায়ী খনন করবে বিআইডব্লিউটিএ। এ সকল নদীর যে অংশ ইতোমধ্যে পাউবো ড্রেজিং করছে বা করেছে, ওই এলাকা বাদ দিয়েই পুরো নদী ড্রেজিং করা হবে।
নদী ড্রেজিং এর ফলে হাওরাঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা ফিরে আসবে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি হবে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভাটিতে নেমে যাবে। হাওরাঞ্চলের ইরি-বোরো ফসলকে আগাম বন্যা থেকে রক্ষার পাশাপাশি বন্যার পানিও বেশিদিন আটকে থাকবে না। পর্যটন বৃদ্ধি পাবে। মাছের প্রজনন অনেকগুণ বেশি বৃদ্ধি পাবে। নদীতে শুকনো মৌসুমে থাকবে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি। এতে সেচ সুবিধা আরও সহজ হয়ে উঠবে। কম খরচে মালামাল পরিবহনে সুবিধা বাড়বে বলে জানা গেছে।