গৌরব-ঐতিহ্যে মুরারিচাঁদ কলেজের ১৩৩ বছর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০২৪, ১:১৮:৩৬ অপরাহ্ন
লবীব আহমদ : শিক্ষা, গৌরব আর ঐতিহ্যে ১৩৩ বছরে পা রাখছে বাংলাদেশের অন্যতম শতবর্ষী প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ। সিলেট অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা হওয়া এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমলের তৎকালীন আসাম প্রদেশের প্রথম কলেজ। ১৮৯২ সালের ২৭ জুন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৪ জন শিক্ষক ও ১৮ জন ছাত্র নিয়ে এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) কোর্স চালুর মাধ্যমে মুরারিচাঁদ কলেজের শুভ সূচনা হয়।
এটি এর আগে মুরারিচাঁদ হাইস্কুল নামে ১৮৮৬ সালে সিলেটের রায়নগরের জমিদার মুরারিচাঁদ রায়ের কন্যা ব্রজসুন্দরী দেবীর দত্তক পুত্র রাজা গিরিশচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৯১২ সালের ১লা এপ্রিল ৯৮ জন ছাত্র এবং ছয়জন শিক্ষক নিয়ে সরকারি কলেজ হিসেবে মুরারিচাঁদ কলেজের যাত্রা শুরু হয়। আসাম সরকারের শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া) এর উদ্যোগে ১৯২১ সালের ১৯ আগস্ট সিলেট শহর থেকে ৩ মাইল দূরে কলেজটির বর্তমান অবস্থান থ্যাকারে টিলায় আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিস কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
পরে ১৯২৫ সালের ২৭ জুলাই আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম রীডের এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুরারিচাঁদ কলেজ বর্তমান ক্যাম্পাসে রূপান্তরিত হয়। ১৯১৯ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে শুভাগমন করলে ৭ নভেম্বর কলেজ হোস্টেলে কবিগুরুকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
এমসি কলেজ নামে দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত মুরারিচাঁদ কলেজের অগণিত শিক্ষার্থী বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন এবং উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। বর্তমানে এই কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকই কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। এছাড়াও কলেজে পড়ালেখা করে কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষও হয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বর্তমানে কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে রয়েছেন কলেজেরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজ।
কলেজ ক্যাম্পাস: মুরারিচাঁদ কলেজ ক্যাম্পাস সিলেট নগরের টিলাগড়ে অবস্থিত। কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর সুবিশাল দিঘীর বামপার্শ্বে শহীদ মিনার অবস্থিত। কলেজের সম্মুখভাগের মূল প্রবেশ পথে ঢুকতে বামদিকে উচুঁ টিলার উপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, কলা ভবনের সিঁড়ির দুইপাশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছে। কলেজের সামনের মূল ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে রাস্তার ডানদিকে সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়ার অসমাপ্ত ম্যুরালের নিকটে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গিরিশ চন্দ্র রায়ের ম্যুরাল রয়েছে।
কলেজে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, একটি অডিটোরিয়াম, একটি ছাত্র সংসদ ভবন, একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন, একটি জ্যুওলজিক্যাল মিউজিয়াম, একটি মসজিদ, একটি পোস্ট অফিস, আসাম প্যাটার্নের ৬ টি ব্লক নিয়ে গঠিত একটি ছাত্রাবাস, ৪ তলাবিশিষ্ট অপর একটি ছাত্রাবাস এবং দুইটি ছাত্রীনিবাস রয়েছে; রয়েছে শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য ৩ টি বাস, একটি সুবিশাল খেলার মাঠ ও বি. এন. সি. সি-রোভার স্কাউট, রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ ১৪ টি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-বিজ্ঞানভিত্তিক সংগঠন/ক্লাব রয়েছে।
শিক্ষা-কার্যক্রম: এই কলেজে বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক (শুধু বিজ্ঞান শাখা), কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (পাস) ১৫ টি বিষয়ে স্নাতক(সম্মান) এবং ১৬ টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে। কলেজের ৯ টি একাডেমিক ভবনে ১২০ জন শিক্ষকের অধীনে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন।
এছাড়াও কলেজের অভ্যন্তরে একটি শিশু বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে শিশুরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পারে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে এবং ১৯৯২ সাল থেকে এর স্নাতক কোর্স ও ১৯৯৫ সাল থেকে স্নাতকোত্তর কোর্স জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
পুরাতন ভবন: ১৯২১ সালের ১৯ আগস্ট থ্যাকারে টিলায় মুরারিচাঁদ কলেজের যে ভবনগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, সেগুলো এখনও শতবছরের ঐতিহ্য লালন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং সেখানে কার্যক্রমও চলছে। যেখানে কলেজের অধ্যক্ষ বাংলো, প্রশাসনিক ভবন, কলাভবন ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার রয়েছে। এছাড়াও কলাভবনের সামনে থাকা পুরোনো টিনশেডের এ্যানেক্স ভবনও ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। কলাভবনে কাঠের সিড়ি রয়েছে, যেটি লোহাকাঠ দ্বারা তৈরি যা এখনও বহমান। এই ভবনগেুলোতে থাকা শতবছরের পুরাতন কয়েকটি বৈদ্যুতিক পাখা এখনও সচল রয়েছে। যেগুলো নষ্ট হলে মেরামতের আর কোনো সুযোগ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সাবেক ছাত্ররা: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানে শহীদ হওয়া আসাদ হচ্ছেন এমসি কলেজের শিক্ষার্থী। এছাড়া এই কলেজ থেকে অনেক গুণী ব্যক্তিরা পড়ালেখা করেছেন।
কলেজ ম্যাগাজিন: ‘দ্যা মুরারিচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিন’ নামে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত হয় ৮ সংখ্যার কলেজ বার্ষিকী। যাত্রা শুরুর বিভাগোত্তর সময়ে ‘মুরারিচাঁদ কলেজ বার্ষিকী’ নামে এটি প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এটির নামকরণ করা হয় ‘পূর্বাশা’। তখন থেকেই এটি ‘পূর্বাশা’ নামেই প্রকাশিত হয়ে আসছে।
কলেজ লাইব্রেরি: বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এমসি কলেজে রয়েছে। যেখানে বর্তমানে ২৭ হাজার ৮২৫টি বই রয়েছে। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুরারিচাঁদ কলেজ আজ ১৩৩ বছরে পদার্পণ করেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তৎকালীন সিলেট অঞ্চলসহ ময়মনসিংহ ভারতের আসাম সহ এই বৃহৎ অঞ্চলের শিক্ষার প্রসারে বড় ভূমিকা রেখেছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে আমরা এবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছিনা। বর্তমানে এই কলেজে আধুনিক শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বিপুল সংখ্যক বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির সুযোগ পাচ্ছেন। অনার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত হয়ে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা সুনাম বয়ে নিয়ে আসছেন। ইতিমধ্যে জয়বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড দু’বার অর্জন করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলের আন্তরিকতায় শিক্ষার পরিবেশ প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, আগামীতে আরো দক্ষ মানবিক দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো- এটি আমাদের অঙ্গীকার।