ডিবি পুলিশের জালে হরিপুরের চিনির চোরাচালান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুলাই ২০২৪, ৯:৪৯:৫৩ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
হরিপুরভিত্তিক চিনি চোরাচালান রোধে অ্যাকশনে নেমেছে পুলিশ। এর অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার মহানগর পুলিশ আড়াই হাজার বস্তা ভারতীয় চোরাই চিনি জব্দ করেছে। জব্দকৃত চিনির দাম ১ কোটি ৪৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এ সময় ৭টি ট্রাকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে ৭ জনকে। এর মধ্যে ৫ জনই পাবনা জেলার বাসিন্দা। গ্রেফতারের পর ট্রাক চালক সাইফুল ইসলাম পুলিশকে জানিয়েছে, তার ট্রাকের মালগুলো হরিপুরের সালমানের।
সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পুলিশ কমিশনার তাহিয়াত আহমেদ চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার বিপুল পরিমাণ চোরাই চিনি, ৭টি ট্রাকসহ ৭ জনকে আটকের কথা জানিয়েছেন। সিলেটের ডাককে তিনি বলেন, আটককৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ভারতীয় চোরাই চিনির এই চোরাচালান হরিপুর থেকে নিয়ে আসা হচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তারা এই চোরাচালানের মূল মালিকদের নামও প্রকাশ করেছে। ডিবি বিষয়টির তদন্ত করছে। তবে, তদন্তের স্বার্থে এ তথ্য আপাতত প্রকাশ করা হচ্ছে না। চোরাচালানের মূল মালিককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান ডিবির ডিসি।
যেভাবে অভিযান চালানো হয়
সীমান্তের ওপার থেকে নিয়ে আসা চোরাই চিনির একটি বড় চোরাচালান কৌশলে শাহপরান বাইপাস দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বলে নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে সংবাদ আসে। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর পেয়ে ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ডিবির একটি টিম গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সিলেট-তামাবিল সড়কের সুরমা গেইট এলাকায় অবস্থান নেয়। রাত চারটার দিকে এক সাথে সাতটি ট্রাক আসতে থাকলে তারা ট্রাকগুলোকে থামাতে সিগন্যাল দেন। কিন্তু ট্রাক চালকরা আরও বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালাতে থাকলে পেছন থেকে ডিবির টিম ধাওয়া করে। পরে শাহপরান সেতুর উত্তর দিকে ছয়টি ট্রাক আটক করতে সক্ষম হলেও পেছনের ট্রাক ফিরিয়ে উল্টো দিকে যেতে থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে ডিবির টিম শাহপরান থানা পুলিশকে বিষয়টি জানায়।
এ সময় ডিবি শাহপরান সেতু এলাকা থেকে ৬টি ট্রাকে থাকা মোট ২ হাজার ৪০ বস্তা চিনিসহ ট্রাকগুলো জব্দ করেন। জব্দকৃত চিনির দাম-১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ সময় গ্রেফতার করা হয় ৫ জনকে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে- পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার আন্দরকুটা গ্রামের মৃত রহিম প্রমাণিকের পুত্র মো. হাফিজুর রহমান (২৭), রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার খরেরবাড়ি গ্রামের আত্তার আলীর পুত্র মো. শিমুল হক (২৯), নাটোর জেলার সদর উপজেলার রমজান আলীর পুত্র মো. আরিফুল ইসলাম (২৫), পাবনা জেলার সদর উপজেলার নাজিরপুর কাজিপাড়ার বাদল প্রামানিকের পুত্র মো. রফিক হোসেন (৩২) ও একই গ্রামের সিরাজ সিরাইর পুত্র মো. হাফিজুর রহমান (২৮)।
গ্রেফতারের পরে চিনি ভর্তি ৬টি ট্রাকসহ তাদেরকে শাহপরান থানায় নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনায় ডিবির এএসআই কিশোলাল দে বাদী হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার শাহপরান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর – ১১।
এদিকে, ট্রাকের বহর থেকে পালিয়ে যাওয়া অপর ট্রাক আটকাতে জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুলের সামনে ব্যারিকেড দেয়া হয়। শাহপরান মাজার তদন্ত কেন্দ্রের এসআই আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে এ সময় চিনি ভর্তি ওই ট্রাকটি জব্দ করা হয়। গ্রেফতার করা হয় সাইফুল ইসলাম ও শাকিল শেখ নামের দু’জনকে। এই ট্রাকে পাওয়া যায় ৪০০ বস্তা ভারতীয় চোরাই চিনি। যার দাম ২৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা। গ্রেফতারকৃত সাইফুল ইসলাম পাবনা জেলার সদর উপজেলার জালালপুরের আব্দুস ছাত্তার বিশ্বাসের পুত্র ও শাকিল শেখ একই উপজেলার বাবুলচরা গ্রামের জাহান শেখের পুত্র। এ ঘটনায় সাইফুল, শাকিল ও পলাতক সালমানের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে শাহপরান থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। এসআই আব্দুল আজিজ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর -১০।
গত সোমবার দৈনিক সিলেটের ডাকে ‘চোরাই চিনির নিরাপদ জংশন হরিপুর’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই আলোচিত প্রতিবেদন প্রকাশের তিনদিনের মধ্যেই হরিপুর থেকে নিয়ে আসা চোরাই চিনির চোরাচালান ডিবি পুলিশ আটক করে।
চিনির মালিক হরিপুরের সালমান
জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুলের সামন থেকে ৪০০ বস্তা চিনিসহ গ্রেফতারকৃত ট্রাক চালক সাইফুল ইসলাম পুলিশকে জানিয়েছে, তার ট্রাকের চিনির মালিকের নাম সালমান (৩০)। সালমানের বাড়ি হরিপুর এবং তার বয়স ৩০ বছর হবে বলেও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন সাইফুল। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত অন্য ট্রাকের চালকরাও চিনির মালিক সম্পর্কে পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতরা এ পর্যন্ত তিন জনের নাম স্বীকার করেছে। তিনজনই হরিপুরের বাসিন্দা। তাদের দেয়া তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। ডিবির ডিসি তাহিয়াত আহমেদ চৌধুরীও জব্দকৃত চিনি চোরাচালানের মালিক হিসেবে কয়েকজনের নাম গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে বলে জানান।
কালিঘাটে জব্দ চোরাই চিনি
এদিকে, বৃহস্পতিবার কালিঘাটের কালি মন্দিরের পার্শ্ববর্তী হুজাইফা কর্পোরেশন বিডি নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তার উপর থেকে ৪০ বস্তা চিনি জব্দ করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এছাড়াও, আরও ২০ বস্তাসহ মোট ৬০ বস্তা চিনি জব্দ করা হয়। জব্দকৃত চিনির দাম ৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এ সময় একটি নম্বর বিহীন পিক-আপও জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরীর খাসদবিরের রুপসা আবাসিক এলাকায় প্রবেশের গেইট থেকে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬০ টাকার ৪৬ বস্তা চোরাই চিনিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে- গোয়াইনঘাটের ঘোষগ্রামের জালাল উদ্দিন (৫৩) একই উপজেলার লেঙ্গুরা গ্রামের রাসেল আহমদ (২৪) ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালিবাড়ির রিপন মিয়া (২৫)। এ সময় একটি পিক-আপও আটক করা হয়।
প্রশ্নবিদ্ধ জৈন্তাপুর থানা পুলিশের ভূমিকা
প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে হরিপুর বাজারে চোরাই চিনির চোরাচালান আনা-নেওয়া হলেও জৈন্তাপুর থানা পুলিশ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার অভিযোগ উঠেছে। গত রোববার রাতে এ প্রতিবেদক জৈন্তাপুর থানার ওসি তাজুল ইসলাম পিপিএমকে হরিপুরে চোরাই চিনি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি আশ্বর্যান্বিত হয়ে বলেন, প্রতিবেদকের কাছ থেকে প্রথম হরিপুরে চিনি চোরাচালানের বিষয়টি শুনেছেন। হরিপুরে চোরাই চিনির চোরাচালান আনা-নেওয়া হয় এমন খবর তিনি আগে কখনো শোনেননি। অথচ গতকাল ডিবির জালে জব্দ হওয়া প্রায় দেড় কোটি টাকা দামের আড়াই হাজার বস্তা চিনি এই হরিপুর থেকেই পাচার করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে খোদ ডিবির ডিসি তাহিয়াত আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন’র সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা চোরাই চিনির বিষয়ে নীরব তাদের বিষয়ে তদন্ত করলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। বিশেষ করে হরিপুরের চোরাচালান নিয়ে জৈন্তাপুর থানা পুলিশের এমন ভূমিকা রীতিমতো প্রশ্ন তৈরি করেছে। এতে করে সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের ব্যাপারে ভুল ম্যাসেজ যাবে-ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হবে। এ বিষয়ে তিনি পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।