জীবিকা সংকটে কোম্পানীগঞ্জের মানুষ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০২৪, ২:১৬:৪৩ অপরাহ্ন

আবিদুর রহমান, কোম্পানীগঞ্জ থেকে : কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার লাছুখাল গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ ফাতেমার চোখেমুখে শুধুই হতাশা। বানের জল কেড়ে নিয়েছে তাঁর ঘর। গোলাভর্তি ধান, বাসনকোসন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব। হারিয়েছেন বসতভিটেও। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত ফাতেমাদের কাটছে দুর্বিষহ দিন।
ফাতেমা বলছিলেন, স্বামী রুক্কু মিয়া কৃষিকাজ করতেন। পাঁচ বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক করেন। তারপর থেকে প্যারালাইজড। সব গুলো হাত-পা অবশ। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে তাই পড়েছেন বিপাকে। কী খাবেন, কীভাবে চলবেন, ঘরের কী হবে। কিছুই মাথায় আনতে পারছেন না। বসতভিটা বলেও তো আর কিছু নেই।
ফাতেমার পাঁচ ছেলের প্রত্যেকে বিবাহিত। প্রত্যেকের রয়েছে চার-পাঁচটি করে সন্তান। দিনমজুরি করে কোনোরকম চলে যেত পাঁচ পরিবারের সংসার। চলতি বছর চার দফা বন্যায় তারাও সর্বস্বান্ত।
ফাতেমার তিন মেয়ে। দুইজনের বিয়ে হয়েছে বি বাড়িয়া জেলায়। আরেক মেয়েকে গ্রামেই পাত্রস্থ করেছেন। মেয়ের জামাই লিবিয়া থেকে ইটালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়। এক বছর ধরে তার সন্ধান নেই। সবমিলিয়ে ভালো নেই ফাতেমাদের পরিবার।
একই অবস্থা বুড়দেও গ্রামের শাকের আলীর। বন্যার তীব্র ¯্রােতের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে তাঁর বসতঘর। হঠাৎ গৃহহীন হয়ে শাকের এখন ৯ জনের পরিবার নিয়ে পড়েছেন অকুলপাথারে।
শাকের আলীর পৈতৃক নিবাস কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাখেরগাঁওয়ে। সন্তানদের পড়াশোনা ও সুবিধার কথা চিন্তা করে এক দশক আগে বুড়দেও গ্রামে এসে বাড়ি বানিয়েছিলেন। এখন গৃহহীন হয়ে পরিবার নিয়ে আবার বাপের ভিটায় বড় ভাইয়ের আশ্রয়ে উঠেছেন। অল্পবিস্তর চাষাবাদ করে কোনোমতে সংসার চলত শাকের আলীর। টানাটানির সংসার বন্যার ছোবলে আরো বেহাল হয়ে পড়েছে। জরুরি কিছু জিনিসপত্র আর চারটি গরু কেবল সরাতে পেরেছিলেন।
একই গ্রামের দুই ভাই শওকত আলী ও আমির আলী। দুজনেরই পেশা কৃষি। কৃষির আয় দিয়েই চলে যেত দুই ভাইয়ের ১২ সদস্যের পরিবার। বারবার বন্যায় জীবিকা সংকটে তারা। বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বসতঘর। কৃষিকাজও বন্ধ। অসহায় দুই ভাই শূন্য ভিটায় ঘর তোলার স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাচ্ছেন।
লম্বাকান্দি গ্রামের জয়নাল প্যারালাইজড হয়ে ঘরবন্দি। ছয় ছেলে-মেয়ে তাঁর। সবাই ছোট। দশ বছরের ছেলেটি উপার্জনক্ষম হলেও সে এখন কর্মহীন। তাই নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের।
পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের হাশমত আলী বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন হাঁস ও মুরগির খামার। খামারের আয় দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু একের পর এক দুর্যোগের কারণে খামারটিও আর টিকল না। খামারি হাশমত এখন বেকার।
বারবার দুর্যোগের কারণে হাশমতের মতো জীবিকা সংকটে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ। পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। একটি দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না করতেই হানা দিচ্ছে আরেকটি। যে কারণে ফসলি জমি, মাছের খামারসহ এলাকার ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বেকার হয়ে পড়েছেন অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। প্রতিটি সংসারে দেখা দিয়েছে অভাব-অনটন।
একই উপজেলার পাড়ুয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম বেড়াই ও নোয়াগাঁওয়ের আবদুল ওয়াহিদও ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে বিপর্যস্ত। দুজনেরই এক সময় ছিল পাথরের ব্যবসা। কয়েক বছর আগে ভোলাগঞ্জ কোয়ারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সেই ধাক্কা সামলানোর আগেই ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যা এবং চলতি বছরের চার দফা বন্যায় তছনছ হয়ে গেছে দুজনের জীবন।
নুরুল ইসলাম ও আবদুল ওয়াহিদ জানান, পাথরের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন লক্ষাধিক মানুষ। কোয়ারি বন্ধ হওয়ার পর নিম্ন আয়ের মানুষ কানোরকম টিকে থাকার লড়াই করছিলেন। কেউ কৃষি আর কেউ পর্যটননির্ভর কাজে জড়িয়ে ছিলেন। কয়েক দফা বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ঘরে ঘরে এখন হাহাকার চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা পাথরকেন্দ্রিক ছিল। কয়েক বছর ধরে পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে এসব নিম্নআয়ের মানুষ বিকল্প পেশা হিসেবে মৎস্য, কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। কেউ কেউ স্থানীয় পর্যটনের সঙ্গে জড়িয়ে নেন। ঘুরে দাঁড়ানোর এই যুদ্ধে প্রথম ধাক্কা আসে ২০২২ সালের বন্যায়। অভাবের সংসারে সর্বশেষ পেরেক ঠুকে দেয় চলতি বছরে চার দফা বন্যা। কৃষি ও মৎস্য দিয়ে যারা ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন বন্যায় তাদের সর্বনাশ ঘটেছে। নষ্ট হয়েছে ফসল। পুকুর ও খামারের মাছ ভেসে গেছে বানের পানিতে। পর্যটনকেন্দ্রভিত্তিক পেশায় নিজেদের জড়িয়ে ছিলেন অনেকে। বন্যায় পর্যটকরা সিলেটবিমুখ হওয়ায় তাদের ভাগ্যেও নেমে এসেছে অমানিশা।
ভোলাগঞ্জ দশ নম্বর এলাকার পর্যটন ব্যবসায়ী সিজুল জানান, বারবার বন্যার কারণে পর্যটন ব্যবসায়ীরা পথে বসার উপক্রম হয়েছেন। পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে অমানিশা। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন। এই ব্যবসায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর আলম বলেন, বর্তমানে এলাকায় কোনো কাজ নেই। বারবার বন্যা সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে। গত তিন-চার বছরে এ ইউনিয়ন থেকে অন্তত দুই হাজার মানুষ এলাকা ছেড়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন বলেন, দুর্যোগে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রথম দফা বন্যায় ৪৭ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা নষ্ট হয়। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ৫৪০ হেক্টর আউশের ৪৩২ হেক্টর ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। ৩৪১ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে।